বাংলাদেশকে সবসময় বলা হয়ে থাকে সম্প্রীতির দেশ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ঠাঁই নেই। এটি যে শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এমনটি নয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ ৬ ফুট দূরত্বের মধ্যে মসজিদ ও মন্দিরের অবস্থান। সেই সঙ্গে সেখানে কোনো বিবাদ ছাড়াই ৮০ বছর ধরে চলা উভয়ের প্রার্থনা।
পাঠকের কাছে বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো হলেও ঘটনাটি সত্য। আর এমন সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত রয়েছে লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ি এলাকায়। মন্দিরটির নাম রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী শ্রীশ্রী দূর্গা ও কালী মন্দির আর মসজিদটির নাম পুরান বাজার জামে মসজিদ।
একই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন মন্দিরে আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের প্রার্থনা করে থাকেন। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা যখন মসজিদে নামাজ আদায় করেন তখন মন্দিরে বন্ধ রাখা হয় পূজার বাদ্য-বাজনা। ৮০ বছর ধরে এভাবেই একই আঙ্গিনায় দুই ধর্মের মানুষজন নিজ নিজ ধর্মচর্চা করে আসছেন কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া। এমনি এতবড় সময়ে উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে সৃষ্টি হয়নি কোনো বিবাদ।
ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন নিদর্শন দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন এখানে। তারা স্থানদুটি ঘুরে দেখার পাশাপাশি কথা বলেন মন্দিরে আসা পূজারী ও মসজিদে আসা মুসল্লিদের সঙ্গে। তাই তো ৮০ বছরের এই ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধনকে তারা আখ্যা দিয়েছেন মানবতার বন্ধন হিসেবে।
ঢাকা থেকে আসা দর্শনার্থী ওয়াসিম খান বলেন, একই আঙ্গিনায় মন্দির-মসজিদ থাকার কথা শুনে আমি দেখতে এসেছি। এটি দেখে আমি মুগ্ধ। কয়েক যুগ ধরে একই আঙ্গিনায় পৃথক ধর্মের দুটি প্রতিষ্ঠান থাকার পরও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটনা মানবতার চিরন্তন বন্ধন হিসেবে উদাহরণ তৈরি করেছে।
জানা যায়, মন্দিরটি ১৮৩৮ সালে আর মসজিদ ১৯৪৩ সালে স্থাপিত হয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই আঙ্গিনায় হলেও এর মালিক অন্যজন। মন্দিরটি তৈরি হয়েছে ৮ শতাংশ জমিতে আর মসজিদটি হয়েছে পাঁচ শতাংশ জমিতে। পুরো আঙ্গিনার জমির পরিমান ১২ শতাংশ।
মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, আমাদের মাঝে কোনো দিন কোনো হিংসা জন্মেনি। এমনকি কারো মধ্যে কোনো দিন কথা কাটাকাটি পর্যন্ত ঘটেনি। আমরা এখানে সম্প্রীতির সঙ্গে অবস্থান করছি। আমরা এখানে খুবই ভালো আছি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এখানে এসে আমাদের সঙ্গে মতিবিনিময় করেন।
অন্যদিকে মন্দির কমিটির সভাপতি ও পুরোহিত শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, মুসলমানদের নামাজের সময় মন্দিরে পূজার্চনা করতে আমরা কখনো বাঁধার সম্মুখীন হইনি। নামাজের সময় আমরা সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো বন্ধ রাখি। প্রতিবছর এই মন্দিরে দূর্গা ও কালী পূজা হয়। পূজা চলাকালীন মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনই আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন।
এ সময় শঙ্কর চক্রবর্তী জানান, সম্প্রতি মন্দির-মসজিদের আঙ্গিনার জমির মালিক এটি বিক্রির প্রন্তুতি নিয়েছে। কিন্তু আমাদের জমি কেনার সামর্থ্য নেই। সরকার যদি জমিটুকু কিনে মন্দির-মসজিদকে দান করে তাহলে আমরা উপকৃত হবো। সেই সঙ্গে অনন্তকাল ধরে এই সম্প্রীতির বন্ধনটি ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম দুলাল বলেন, মন্দিরে নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা করতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে আমরা সবসময় সহযোগিতা করে থাকি। এই বিষয়টি শুধু লালমনিরহাটের জন্য নয়, সারাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। আমরা এখানে উভয় ধর্মের লোকজন ভালো আছি, সম্প্রীতির সাথে বসবাস করছি।।
এসময় তিনি বলেন, আঙ্গিনার জায়গাটুকু সরকারি ব্যবস্থায় ক্রয় করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দুটির নামে দান করলে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই জায়গাটি অনন্তকাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। জমির মালিক এটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমরা দুশ্চিন্তায় রয়েছি। শুধু সরকারই পারে আমাদেরকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে।