ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অন্তর্বাস পরা আটক ফিলিস্তিনিরা তাদের অস্ত্র ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে সমর্পণ করছেন-এমন একটি ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গত শনিবার (৯ ডিসেম্বর) ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিও নিয়ে নানা ধরণের জল্পনা, সন্দেহ আর প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ঘটনার সময়কালের সার্বিক পরিস্থিতি এবং তার ছবি তোলার বিষয়টি নিয়ে অবিশ্বাস আর সন্দেহ দানা বাধছে।
শনিবার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুটি ভিডিওর একটিতে অন্তর্বাস পরা এক ব্যক্তি অস্ত্র নিচে রাখার নির্দেশনা পালন করছেন।অপর ভিডিওতে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। দুটি ভিডিওর মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকার কারণে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে-হয়তো কয়েকটি ‘ধাপে’ একাধিকবার ধারণ করা হয়েছে।
অন্তর্বাস পরা অনেক পুরুষের ছবিতে কয়েক জনকে অস্ত্র তুলে ধরতে দেখা যায়। ছবি: বিবিসি বাংলা
এই ফুটেজ পরীক্ষা করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি’র ‘বিবিসি ভ্যারিফাই’ (বিবিসি যাচাই-বাছাই) টিম। তারা দেখতে পেয়েছে, উভয় ভিডিও চিত্র একটি ধারাবাহিক ক্রম থেকে এসেছে। যে ধারাক্রমে মোট তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র হস্তান্তর করা হয়েছে বলে মনে হয়, তবে সঠিক পরিস্থিতি ও তার ভিডিও প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, কয়েক বারের প্রচেষ্টায় এই ভিডিওগুলো ধারণ করা হয়েছে। অনেকেই কীভাবে একই ব্যক্তি দুটি ভিডিওতে ভিন্ন হাতে বন্দুক ধরেছে তার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছেন।
ভিডিও ফুটেজ নিয়ে ‘বিবিসি ভেরিফাই’ কী বলছে?
বিবিসি ভেরিফাই বলছে, এই ফুটেজগুলো আসলে একটি চলমান ঘটনারই আলাদা দুটি দৃশ্য। তবে, কয়েকবারের প্রচেষ্টায় ধারণ করা ভিডিও নয়, এবং একই ব্যক্তি বারবার যাওয়া-আসা করে আলাদা বন্দুক এবং খুলে রাখা গুলি এনে পায়ে হাঁটা রাস্তার উপর জড়ো করছেন।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাস্তার পাশে আরো কয়েক ডজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে দেখছেন। তারাও অন্তর্বাস পরিহিত এবং তাদের অনেকেই অস্ত্র ও পরিচয়পত্র উপরে তুলে ধরে আছেন।
বিবিসি ভেরিফাই জানতে পেরেছে যে তারা জাবালিয়ার উত্তরে বেইত লাহিয়া শহরে জাতিসংঘের একটি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সূর্যের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে যে, একটি ভিডিও প্রথমে ধারণ করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তি তার ডান হাত দিয়ে একটি বন্দুক ফুটপাতে রাখা আরেকটি বন্দুকের উপর রাখছেন।
পরের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সূর্য নিচে নেমে গেছে, একজন ব্যক্তি আরেকটি বন্দুক এনে বাম হাত দিয়ে অন্যগুলোর উপর রাখছে।
স্থির চিত্রের কারণেই এরই অনুমানগুলো পোক্ত হয়েছে, যেখানে একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি বন্দুক রাখা হয়েছে এবং অন্যটিতে দেখা যাচ্ছে রাস্তার উপর তিনটি বন্দুক ও ম্যাগাজিন রাখা রয়েছে।
ফুটেজ নিয়ে প্রশ্ন আর সন্দেহ
এই ফুটেজ আরো কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, আর তা হচ্ছে ওই ব্যক্তিদের অস্ত্রের মুখে রাখা হয়েছিল এবং তাদেরকে ক্যামেরার পেছন থেকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছিল।
বন্দুক রাখা এই দুটি ভিডিও নিয়ে নানা জল্পনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে। ছবি: বিবিসি বাংলা
তাই এটা স্পষ্ট নয় যে তারা কি আসলে অস্ত্র ‘সমর্পণ’ করছিল নাকি তারা শুধু নির্দেশ মোতাবেক অস্ত্রগুলো সরিয়ে রাখছিল।
কারণ ওই ব্যক্তিকে এরইমধ্যে শুধু অন্তর্বাস পড়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে, এবং তার সেগুলো নিজে লুকিয়ে রাখার মতো অবস্থাও ছিল না।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব অস্ত্র সম্পর্কে জানতো না- এমন সম্ভাবনাও খুবই কম। তার মানে হচ্ছে, বাস্তবিকপক্ষে সমর্পণের পরিবর্তে শুধুমাত্র ক্যামেরায় ধারণ করার জন্যই এমনটা করা হয়েছে।
আমরা জানি না যে, ওই ব্যক্তি বা ভিডিওতে দেখানো আর কোন ব্যক্তি হামাস বা গত সাতই অক্টোবরের হামলার সাথে জড়িত কিনা।
একটি ভিডিওতে শেষের দিকে একটি ডিএসএলআর এর জুম লেন্স খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওর পাশাপাশি ছবিও প্রকাশিত হচ্ছে যেগুলো একটু ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা হয়েছে। এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, এই ঘটনা একাধিক ব্যক্তি এবং একাধিক ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও ধারণা করা হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে গাজায় ফিলিস্তিনি বন্দিদের ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অনেকেই।
এই ছবিটিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। ছবি: বিবিসি বাংলা
বন্দিদের সাথে হওয়া আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। রেড ক্রস ইতোমধ্যে বলেছে যে, আন্তর্জাতিক আইন মেনেই বন্দিদের সাথে আচরণ করা উচিত।
কিন্তু গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যে অগ্রগতি অর্জন করছে তার প্রমাণ দেখাতে আগ্রহী দেশটি।
ইসরায়েল সরকার কি বলছে?
রোববার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “সম্প্রতি কয়েক দিনে, হামাসের কয়েক ডজন যোদ্ধা আমাদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তারা তাদের অস্ত্র জমা দিচ্ছে এবং নিজেরা আমাদের বীরোচিত যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে।”
এসময় তিনি আরো বরেলন,‘আরো সময় লাগবে, যুদ্ধ পুরোদমে চলছে, কিন্তু এটা হামাসের সমাপ্তির শুরু।’
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এসব ভিডিওর ঘটনা নিয়ে করা প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়নি। তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বিবিসির কাছে দাবি করেন, আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আচরণ করা হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রায়ই তাঁদের শরীর থেকে পোশাক সরিয়ে নিতে হয়, যাতে তাঁদের তল্লাশি করা যায়। নিশ্চিত করা যায়, তাঁরা বিস্ফোরক বা অন্য অস্ত্র লুকিয়ে রাখছেন না।
প্রসঙ্গত, আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ি আল আকসা মসজিদের অপবিত্রতা এবং কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নৃশংসতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চলতি বছরের ৭ অক্টোবর স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে তারা নজিরবিহীন রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে গাজায় অবরোধ দিয়ে রেখেছে ইসরায়েল। শুধু তাই নয়, গত বছর থেকে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরের শহরগুলোতে সামরিক অভিযান দেশটির সেনাবাহিনী। পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রকেট হামলা চালায় হামাস। আর এর জবাবে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে ইসরায়েল।
হামাসের হামলায় দেশটির ১ হাজার ২০০ জন বেসমারিক নিহত হন। সেদিন ইসরায়েলের ২৪০ জনকে জিম্মিও করে হামাস। হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই গাজায় নির্বিচারে বোমা হামরা শুরু করে ইসরায়েল বাহিনী। এর পর থেকে অব্যাহত হামলায় গাজার ১৮ হাজারের বেশি বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।