নিজের জমি বেচে রাস্তা বানালেন এক কৃষক
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নিজ অর্থে রাস্তা নির্মাণ করেন গাজী কামাল হোসেন নামে এক কৃষক। এ কাজ করায় সবাই কামাল হোসেনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রাম থেকে পূর্ব সোনাতলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পেছন পর্যন্ত রাস্তাটি নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কামাল হোসেন সড়কটি নির্মাণ করার জন্য নিজের ৩০ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি ১ হাজার ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের, ১৪ ফুট প্রস্থের এবং ১৪ ফুট উচ্চতার গ্রামীণ রাস্তাটি নির্মাণ করেছেন। গেলো ২০ জানুয়ারি রাস্তাটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ৫ ফেব্রুয়ারি রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে।
কৃষক কামাল হোসেন বলেন, ‘এক বছর আগে আমি ভেড়ির (ছোট রাস্তা) ওপর দিয়া হাইট্টা যাইতেছিলাম। তহন ভেড়ির ওপর দিয়া এক গর্ভবতী মাকে একটা ভ্যানে কইরা হাসপাতালে লইয়া যাইতে দেখলাম। দুর্ভাগ্যবশত ভ্যানটি হঠাৎ বিলের মধ্যে উল্টাইয়া পইড়া যায়। ওই গর্ভবতী মা এই ভেড়ির পাশেই সন্তান প্রসব করেন। এই দৃশ্য দেইখ্যা আমার খুবই খারাপ লাগে। তহনই আমি নিজের অর্থে রাস্তাডা নির্মাণ করার চিন্তা করি।’
কুমিরমারা গ্রামটি নীলগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্যে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এর কারণ হলো এ গ্রামে প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়। বলা যায়, কলাপাড়া উপজেলার মানুষের সবজির একটা বিরাট চাহিদা পূরণ হয় এ গ্রাম থেকে। সবজিচাষিসহ গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সড়কটি ভালো না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষজনকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল। বর্ষা মৌসুমে গ্রামীণ এ পথসহ কুমিরমারা গ্রামটি আন্ধারমানিক নদের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। এতে কৃষককুলের চাষাবাদও ব্যাহত হতো। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চলাচলেও অসুবিধা হতো। এলাকার মানুষসহ কৃষকের দুর্ভোগ দেখে গ্রামের সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন কৃষক কামাল হোসেন।
কামাল হোসেন বলেন, এক্সকাভেটর (মাটি খনন করার যন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে এ রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া ১০-১২ জন শ্রমিক রাস্তা নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছে। এতে তাঁর ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। বর্তমানে রাস্তাটির ওপরের এবং দুই পাশের মাটি মসৃণ করার কাজ চলছে। সামনের বর্ষায় তিনি এ রাস্তার দুদিকের ঢালে ঘাস লাগিয়ে দেবেন বলে জানান। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ ও বনজ গাছ রোপণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। রাস্তাটি মসৃণ করতে আরও টাকা দরকার। এ জন্য গোয়ালের গরু বিক্রি করার চিন্তা করেছেন কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার হাতে টাকা আছিল না। যে কারণে আমার নিজের ৩০ শতাংশ জমি বিক্রি করতে হইছে। জমি বিক্রির সাত লাখ টাকায় রাস্তাডা নির্মাণ করতে সক্ষম হইছি। এ রাস্তার মাঝখান দিয়ে এখন যদি একটি পানি নিষ্কাশনের জলকপাট করে দেয়া হয়, তাহলে কৃষকদের অনেক উপকার হবে।’
এর আগে ২০০৭ সালে নিজ অর্থায়নে নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাশ দিয়ে কুমিরমারা খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিয়েছিলেন কামাল হোসেন। ৩৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকোটি তৈরি করতে তখন তার দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। পরে প্রতিবছর সাঁকো মেরামত করতে তার এক লাখ টাকা করে খরচ হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছরে সাঁকোর ওই জায়গায় লোহার কাঠামো দিয়ে সেতু নির্মাণ করে দেয়। এ ছাড়া তিনি এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থসহায়তা, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে আর্থিক সহায়তাসহ জনহিতকর বহু কাজ করেছেন। এসব কাজের জন্য স্থানীয় গ্রামবাসী তাকে ২০১০ সালে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেন।
জাকির হোসেন নামের এক সবজিচাষি বলেন, ‘কুমিরমারা গ্রামে সবচাইতে বেশি সবজি চাষ হয়। এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষই কৃষক। দীর্ঘদিন ধইরা রাস্তা না থাহার কারণে আমাগো খেতের তোলা সবজি বাজারে লইয়া যাইতে কষ্ট হইত। আমরা এই রাস্তাডার লাইগা মেম্বার-চেয়ারম্যানরেও বহুবার কইছি। রাস্তার লাইগা আমরা গ্রামবাসী মানববন্ধন করছি, কিছুই হয় নাই। আমাগো পাশে শ্যাষ পর্যন্ত কামাল হোসেনই দাঁড়াইলেন। রাস্তাডা কইরা দিয়া তিনি একটা মহৎ কাজ করলেন।’
নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবুল মিয়া বলেন, ‘যে কাজ আমরা করতে পারিনি, তা কৃষক কামাল হোসেন করেছেন। সত্যিই তিনি ভালো কাজ করেছেন। তিনি এ সমাজের এক আলোকবর্তিকা, যা অনুকরণীয় এবং সবার জন্য দৃষ্টান্তমূলক। রাস্তাটি নির্মাণ হওয়ায় ওই এলাকার অন্তত দুই হাজার মানুষের কষ্ট দূর হয়েছে। তা ছাড়া এ রাস্তা হওয়ায় ধুলাসার, ডালবুগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, বালিয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দারাও সহজে এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারবে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাতে একটি জলকপাট নির্মাণ করা যায়, সে চেষ্টা অবশ্যই করা হবে।’