গরীবের চিকিৎসকের বর্নাঢ্য জীবন
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও চিকিৎসা সেবায় এক অনন্য নাম। একজন ডাক্তার হয়েও মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদার রেখেছেন তিনি। মানুষের অধিকার নিয়েও সরব ছিলেন এই কীর্তিমান চিকিৎসক। যেকোনো অন্যায় ও অসমতার বিষেয় প্রতিবাদী ছিলেন এই মানুষটি।
সবার জন্য সুলভমূল্যে ওষুধ নিশ্চিত করতে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন ওষুধ নীতি। যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বর্তমান ওষুধ শিল্প। ১৯৮২ সালে প্রণীত ওষুধ নীতির অন্যতম রূপকার ছিলেন প্রতিভাবান এই চিকিৎসক। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং গরীবের চিকিৎসক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পেশায় ছিলেন একজন ভাস্কুলার সার্জন।
১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। মা–বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়।
বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ডা. জাফরুল্লাহ। সেই সময় তিনি বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময় হাসপাতালের অনিয়ম–দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেখানেই তিনি সাধারণ সার্জারি ও ভাস্কুলার সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করা, হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল।
বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব, তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রমাণ করে। সেই অভিজ্ঞতার কথা বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুর আগপর্যন্ত ট্রাস্টি হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন সহজভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য সব ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকের দরকার নেই। স্বল্প শিক্ষিত মানুষকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েও সেবা পাওয়া সম্ভব। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্যবিমা চালু হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর কোনো উদ্যোগকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গড়ে তোলা সফল স্বাস্থ্য উদ্যোগ সরকারই যেন সারা দেশে প্রয়োগ করে বা ছড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতার পর দেশের ওষুধের বাজারে বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তখন বাজারে চার হাজার ধরনের ওষুধ ছিল। এর প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ওষুধ ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলের ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। জাতীয় ওষুধনীতি দেশি কোম্পানিগুলোকে ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে দেয়, পাশাপাশি দেশে তৈরি হওয়া ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা বন্ধ হয়।
বৈশ্বিকভাবে বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি আয়োজন করে। এর বিকল্প হিসেবে কয়েক বছর পরপর আয়োজন করা হয় পাবলিক হেলথ অ্যাসেম্বলি বা জনগণের স্বাস্থ্য সম্মেলন। এটা আয়োজন করে পিপলস হেলথ মুভমেন্ট নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠন। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাঁকে দেওয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে থেকে ২০১০ সালে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ২০২২ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘এনআরবি লিবারেশন ওয়ার হিরো ১৯৭১’ পুরস্কার দেয়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ৫০টির বেশি দেশে বিভিন্ন সম্মেলন বা সেমিনারে মূল বক্তা হিসেবে অংশ নেন। একাধিক দেশকে জাতীয় ওষুধনীতি তৈরিতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে একটির নাম রিসার্চ: আ মেথড অব কলোনাইজেশন। এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। এরপর এটি বাংলা ছাড়াও ফরাসি, জার্মান, ইতালি, ডাচ, স্প্যানিশ ও একাধিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে জীবনের শেষ বছরগুলোতে রোগব্যাধির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। জটিল কিডনি রোগে ভুগছিলেন তিনি। মানুষ যেন সহজে প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পেতে পারেন, সে জন্য তিনি আইনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর হাতে গড়ে ওঠা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট তৈরি করেছিলেন। ওই ইউনিটে নিজেই ডায়ালাইসিস করাতেন। ইউনিটটি তিনি করেছিলেন কম মূল্যে সাধারণ মানুষকে সেবার সুযোগ করে দিতে। একটি ক্যানসার হাসপাতাল করার ইচ্ছাও তাঁর ছিল।
মঙ্গলবার ১১ এপ্রিল রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮১ বছর বয়সী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমে নিজের শরীরকেও তিনি মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।