যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুল মতিন গ্রেপ্তার
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়া যুদ্ধাপরাধী মো. আব্দুল মতিনকে (৭০) সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এ আসামি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিলেন।
রোববার (২৩ এপ্রিল) দিবাগত রাতে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেন র্যাব সদস্যরা। গ্রেপ্তার হওয়া যুদ্ধাপরাধী আব্দুল মতিন মৌলভীবাজার বড়লেখার পাখিয়ালার মৃত মিরজান আলীর ছেলে।
সোমবার (২৪ এপ্রিল) র্যাব-৩ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দাখিল করা অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ মতে, আব্দুল মতিন এবং মামলার অপর আসামি তারই আপন ভাই আব্দুল আজিজ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বারপুঞ্জিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তারা পালিয়ে বড়লেখায় এসে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।
আব্দুল মতিন বড়লেখা থানা জামায়াত ইসলামী ও ১৯৭১ সালে গঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আব্দুল মতিনসহ রাজাকার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা মিলে মৌলভীবাজার এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতেন।
১৯৭১ সালের ১৯ মে আব্দুল মতিনসহ এই মামলার অপর দুই আসামি আব্দুল আজিজ, আব্দুল মান্নান এবং তাদের সহযোগীরা মিলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানাধীন ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাস, মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করেন।
তাদের তিনদিন যাবত বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। পরে জুড়ি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়। অপহরণকৃত শ্রীনিবাস দাস নির্যাতিত অবস্থায় কোনোক্রমে পালিয়ে কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে যান।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আব্দুল মতিন, মামলার অপর আসামি আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বড়লেখা থানাধীন কেছরিগুল গ্রামের বাসিন্দা সাফিয়া খাতুন এবং আব্দুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান।
রাজাকার ক্যাম্পে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করেন। পরবর্তীতে তারা টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্প থেকে সাফিয়া খাতুনকে প্রথমে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প এবং কিছুদিন পর বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানেও সাফিয়া খাতুনকে বারবার গণধর্ষণ করা হয়।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর আব্দুল মতিনসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মিলে বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বসতবাড়িতে সশস্ত্র হামলা করে ব্যাপক লুটপাট চালান। মুক্তিযোদ্ধা মঈনের পিতা বছির উদ্দিন, চাচা নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের কিছুদিন আটক রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পরবর্তীতে ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের রাজাকার ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর মতিন, মামলার অপর আসামি আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বড়লেখা থানাধীন হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাকিন কমান্ডারের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা করেন। মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাকিনকে তারা বাড়িতে না পেয়ে তার ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করেন। তাদের অমানবিক নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙে যাওয়াসহ গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মুস্তাকিন ও মতছিন আলীর বসতবাড়িতে লুটতরাজ চালান এবং অগ্নিসংযোগ করে কয়েকটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেন।
১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর আব্দুল মতিন এবং অন্যান্যরা মিলে বড়লেখা থানাধীন ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য তাদের বাড়িতে হামলা চালান। সেখান থেকে তারা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরে তারা মনির আলীর স্ত্রী আফিয়া বেগমকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করা হয়। বসতবাড়িতে হামলা চালানোর সময় হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর ঘরের যাবতীয় মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যান রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
র্যাব-৩ অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর আব্দুল মতিন, আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই এবং আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্তটি ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর শেষ হয় এবং তদন্ত চলাকালীন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১ মার্চ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তারা কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছেন। তবে আব্দুল মতিন তখন গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। ট্রাইব্যুনালের তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে ২০২২ সালের ১৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তিনজনকেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে পলাতক জীবনযাপন শুরু করেন। তিনি মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানাধীন পাখিয়ালা গ্রামের নিজ বাড়ি ছেড়ে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানা এলাকায় তার ভাগ্নের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। সেখানে নিজেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে পলাতক জীবন শুরু করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মতিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার ভাগ্নের বাড়িতে দীর্ঘ সাত বছর পলাতক থাকাকালে গতরাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।