মা-মেয়ে হত্যার নেপথ্যে স্বামীর পরকীয়া-দাম্পত্য কলহ
বাড়ি থেকে প্রায়ই উধাও হয়ে যেতেন এস. এম. সেলিম (৩৪)। কোথায় কার সঙ্গে থাকতেন এসব ব্যাপারে পরিবারের প্রশ্নে কোনো উত্তর দিতেন না তিনি। একাধিকবার স্ত্রীকে মারধর, এমনকি হত্যার চেষ্টাও করেন সেলিম। গত দুই বছরে অন্তত তিনবার পারিবারিক বৈঠক হয় সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা নিয়ে।
বৃষ্টির বাধায় পারিবারিক সে চেষ্টা ভেস্তে যায়। বৃষ্টি বলেছিলেন ‘আর কটা মাস দেখি, যদি বদলায় সে’। তবে সেলিম বদলাননি। বরং পৃথিবী থেকে বৃষ্টিকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন তিনি।
সেই পরিকল্পনা থেকে ৩০টি ঘুমের ওষুধ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে স্ত্রীকে খাওয়ান। স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ খেয়ে ফেলে ৯ বছরের শিশু কন্যা সানজাও। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারা যায় দুজনই।
বুধবার (১৪ জুন) বাড্ডা থানা পুলিশ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর আগে মঙ্গলবার (১৩) দিবাগত রাত ৩টার দিকে ফরাজি হাসপাতাল থেকে মরদেহ দুটি উদ্ধার করা হয়।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে রাজধানীর বনশ্রীর ফরায়েজি হাসপাতাল থেকে মা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে বাড্ডা থানা পুলিশ। সন্দেহভাজন হিসেবে তখনই আটক করা হয় স্বামী সেলিমকে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম মা-মেয়েকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, তিন দিন বাইরে থেকে পরশু রাতে বাসায় ফেরেন। এ নিয়ে পারিবারিক কলহ চরমে ওঠে। পারিবারিক কলহ আর নিজের পরকীয়া সম্পর্কের জেরে স্ত্রীকে সারা জীবনের জন্য সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল না তার।
বাড্ডা থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার খ-২১৬ নং বাসার, ফ্ল্যাট নং-৭সি এর ৮ম তলায় থাকতেন মাহমুদা হক বৃষ্টি ও সেলিম দম্পতি। ঘটনার পর ভোর রাতে স্বজনরা বনশ্রীর ফরায়েজি হাসপাতালে নিয়ে যায় মা-মেয়ের অচেতন দেহ। তখন পর্যন্ত সেলিম বলছিলেন মা-মেয়ে বিষ খেয়েছে।
বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাদেক গণমাধ্যমকে বলেন, আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুজনকে বনশ্রী ফরায়েজী হাসপাতালে নেয়ার খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। পরে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চিকিৎসক মা ও মেয়েকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা স্বামী সেলিমকে আটক করি।
মা-মেয়ে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রথমে সেলিমের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের বরাতে পুলিশ জানতে পারে বিষপানের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। শ্বাসরোধেও হত্যা নয়, মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধের আলামত মিলেছে। পুলিশের বিশদ জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম স্বীকার করেন দুধের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল মা-মেয়েকে।
নাতনী ও মেয়ের মৃত্যুতে হতবিহবল বৃষ্টির বাবা মো. মোজাম্মেল হক বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় সেলিমকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ১৪ বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির মেয়ে মাহমুদা হক বৃষ্টি ও রাজধানী বাড্ডার মো. সেলিমের। দাম্পত্য জীবনে ৯ বছরের সানজা মারওয়া নামে এক মেয়ে ও সারিম নামে একটি ৯ মাসের ছেলে সন্তান আছে তাদের।
বিয়ের পর থেকে তাদের সংসার ভালোই চলছিল কিন্তু প্রায় তিন বছর আগে থেকে সেলিম ও বৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়।
বাবা মোজাম্মেল অভিযোগ করে বলেন, ১৩ জুন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সেলিম আমার দ্বিতীয় মেয়ে মিম আক্তারকে ফোন করে করে জানায়, বৃষ্টি ও নাতনী সানজা কোনো সাড়া শব্দ করছে না এবং তাদের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
খবর পেয়ে আমার ছোট বোন ঝর্ণা আক্তার, আমার বোনজামাই পান্না এবং আমার ভাগিনা বাড্ডার ওই বাসায় গিয়ে বিছানায় বৃষ্টির নিথর দেহ দেখতে পায় এবং পাশের কক্ষে ছোট্ট সানজার নিথর দেহ পড়েছিল।
তিনি বলেন, জামাই সেলিম পারিবারিক ঝগড়া বিবাদকে কেন্দ্র করে আমার মেয়ে ও নাতনীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
নিহত বৃষ্টির মামা সোহেল বলেন, সেলিম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। সংসার তাদের ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনাকালে তার চাকরি চলে যাওয়া পর থেকেই শুরু পারিবারিক কলহ। বাসা ভাড়ার টাকা তুলে উধাও হয়ে যেত সেলিম। একটা পর্যায়ে স্পষ্ট হয়, একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া ও অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত সেলিম।
সোহেল বলেন, পারিবারিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বিচ্ছেদের জন্য পরিবারের চাপেও রাজি হয়নি বৃষ্টি। বৃষ্টির বক্তব্য ছিল, আর কটা মাস দেখি। যদি বদলায় সেলিম। কিন্তু সেলিম বদলায়নি। সম্পর্কও ছেদ করেনি। বরং সারা জীবনের জন্য আমাদের মেয়ে ও নাতনীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল সে।
মামা সোহেল বলেন, সেলিম প্রায়ই বৃষ্টিকে মারধর করত। এর আগেও একবার গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করেছে। খারাপ লাগছে, মেয়েটা দুই সন্তানের মুখ চেয়ে সংসারটা টেনে গেছে। খারাপ লাগছে ৯ মাসের নাতিটার জন্য। এমন বয়সে মা ও বোনকে হারাতে হলো শিশু সারিমকে।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় প্রায় সময় স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হতো। সেলিম পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, পরিকল্পনা করেই গত রাতে বাইরে থেকে দুধ কিনে আনে। সেই দুধে ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। তাতে স্ত্রী বৃষ্টি ও তার শিশু কন্যা সানজা নিস্তেজ হয়ে মারা যায়।
বাড্ডা থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, সেলিম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, স্ত্রীকেই শুধু হত্যার পরিকল্পনা ছিল সেলিমের। কিন্তু ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ খেয়ে ফেলে শিশু সানজাও। যে কারণে মারা যায় সেও।
ওসি বলেন, একটি মামলা হয়েছে। মামলার একমাত্র আসামি সেলিম। মৃত্যুর সঠিক কারণ উঠে আসবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে। ঘটনায় আর কারো ইন্ধন ছিল কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি। বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে আর কার কার সঙ্গে মিশত সেলিম, তাদের কারো যোগসাজশ ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে।