আর্কাইভ থেকে জাতীয়

জঙ্গিদের বন্দিশালায় কেমন ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সুফিউল

প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) দীর্ঘ দেড় বছর পর সাবেক সেনা ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা একেএম সুফিউল আনামকে উদ্ধার করে। তাকে উদ্ধার করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা। ১৮ মাস আগে আল কায়দার হাতে অপহরণ হওয়া ওই কর্মকর্তা দেশে ফিরেছেন।

গেলো বুধবার (১০ আগস্ট) বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তাকে মুক্তি দিতে আল কায়দা ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করলেও কোন ধরনের মুক্তিপন ছাড়াই তাকে উদ্ধার করা হয় বলে জানায় এনএসআই। এর আগে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুফিউল আনামকে মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের মহাসচিব বরাবর চিঠিও পাঠায় তার পরিবার। গেলো বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে অপহরণের শিকার হন বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা একেএম সুফিউল আনাম। এরপর থেকে কোনো খোঁজ মিলছিল না জাতিসংঘে কর্মরত এই কর্মকর্তার। ধারণা করা হয় অপহরণের পর তাকে হত্যা করে জঙ্গিগোষ্ঠী। প্রায় সাত মাস পর গেলো (৭ সেপ্টেম্বর) ওই কর্মকর্তার একটি ভিডিও প্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠীদের অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।

কোনো অপারেশনের মাধ্যমে যদি আমাদেরকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়, তারা আমাদেরকে হত্যা করবে। হত্যা করে ওরা পালিয়ে যাবে। আমি ছিলাম পাহাড়ের মধ্যে, আমি ছিলাম মরুভূমির মধ্যে। আমি আকাশ-বাতাস দেখতে পাই নাই মাসের পর মাস। প্রতিক্ষণ ছিল আমার সন্ত্রাসীদের ভয়। মৃত্যুর ভয়, দুর্ঘটনার ভয়। বলছিলেন সুফিউল আনাম।

ইয়েমেনে আল-কায়েদার বন্দিশালায় দেড় বছর কাটানো সময়ের লোমহর্ষক বর্ণনা দেশে ফেরার পর এভাবেই দিচ্ছিলেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুফিউল আনাম।

বিমানবন্দরে পৌঁছে সেই কঠিন সময়ের কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল পরিবেশে ছিলাম, যেটা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। সিনেমায় দেখা যায়, এটা অ্যাকশন মুভিতে দেখা যায় কী রকম অবস্থায় ছিলাম।

দায়িত্বপালনকালে সশস্ত্র একটি দলের হাতে অপহরণের শিকার জাতিসংঘের কর্মকর্তা সুফিউল আনাম দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে আগের দিন মঙ্গলবার ছাড়া পান। এরপর তাকে আরব আমিরাতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বুধবার দেশে ফেরেন তিনি। বিকালে শাহজালাল বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ওই ‘মৃত্যু ও দুর্ঘটনার’ ভয়ের মধ্যে কাটানো সময়ের বর্ণনা দেন তিনি।

এদিন সোয়া পাঁচটার দিকে তার ঢাকায় পৌঁছার কথা এর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

ইয়েমেনে জাতিসংঘের ৫ কর্মী অপহৃত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুফিউল ইয়েমেনের রাজধানীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের ফিল্ড সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেশন অফিসার হিসেবে ছিলেন। জাতিসংঘের আরও পাঁচ সহকর্মীসহ তাকে অপহরণ করা হয়েছিল।

জিম্মি অবস্থায় ‘অত্যন্ত বিপদসঙ্কুলভাবে’ এই ১৮ মাস পার করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিক্ষণ ছিল আমার সন্ত্রাসীদের ভয়। মৃত্যুর ভয়, দুর্ঘটনার ভয়।

২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি অস্থায়ী একটি চেক পয়েন্ট থেকে অপহরণ করার পর প্রথমে তাদেরকে পাহাড়ি আস্তানায় নিয়ে রাখার কথা জানান সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “আমাকে অপহরণ করা হয়েছে, যখন আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যখন আমি ফিরছিলাম আমার বেইসে। আমার সাথে দুইটা গাড়ি ছিল এবং ছয়জন ছিলাম আমরা দুজন ড্রাইভারসহ।

“আমাদেরকে রাস্তার মাঝখানে একটা মেইকশিফট চেক পয়েন্টে আটক করে আমাদেরকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এবং আমাদেরকে ওখান থেকে নিয়ে পাহাড়ের মাঝখানে এক শেল্টারের মধ্যে আমাদেরকে রাখা হয়।”

১৮ মাসে ১৮ বার এক বন্দিশালা থেকে তাদেরকে আরেক বন্দিশালায় আনা-নেওয়া করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সব মিলিয়ে পৃথক ১০ জায়গায় রাখা হয়েছিল তাদেরকে।

সুফিউল আনাম বলেন, “আমাদের ভাগ্য ভালো যে, তারা আমাদের উপরে কোনো রকমের নির্যাতন করে নাই, কোনো রকম দুর্ব্যবহার করে নাই। তারা শুধু আমাদেরকে চোখ বেঁধে পাহাড়ের মাঝখানে শেল্টারে নিয়ে যায়।

“যতক্ষণ সেখানে (পাহাড়ে) রাখা সম্ভব ছিল, ততদিন তারা আমাদের ওখানে রেখেছে। তার পরে তারা আমাদেরকে ওখান থেকে সরিয়ে মরুভূমির একটি তাঁবুর মধ্যে নিয়ে রেখেছে।

এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “গত দেড় বছরে আমাদেরকে ১৮ বার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়েছে। মোট ১০টি জায়গায়।”

তবে এসব স্থান আদতে কোথায় সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “কারণ আমাদের চোখ সবসময় বাঁধা অবস্থায় ছিল। শুধু এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, প্রথমে আমরা ছিলাম পাহাড়ের ভেতরে তার পরে আমরা ছিলাম মরুভূমির মাঝখানে।”

খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “খাবার দাবার আমাদেরকে ঠিকমত দেওয়া হয়েছিল, যতদিন পর্যন্ত তাদের ফান্ড অ্যাভেইলেভল ছিল, তারা আমাদেরকে খাবারদাবার বা অন্যান্য জিনিস প্রদানের ব্যাপারে কোনো ত্রুটি করে নাই।

“যখন তাদের হাতের পয়সা ফুরিয়ে যায়, টাকাপয়সা শেষ হয়ে যায়, তখন আমরা খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে সময় পার করেছি।”

আল-কায়েদা কী পরিমাণ মুক্তিপণ দাবি করেছিল, সেই সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার কথা উল্লেখ করে সুফিউল বলেন, “আমাকে টার্গেট করেছে, আমি যেহেতু জাতিসংঘের কর্মকর্তা সেই হিসেবে আমাকে টার্গেট করেছে বলে আমার মনে হয়। কারণ, তারা তাদের দাবিদাওয়া পূরণ করার জন্য আমাদেরকে অপহরণ করেছে বলে তারা আমাকে বলেছে।

“এবং আমাকে দিয়ে যেসব ভিডিও ক্লিপ তারা তৈরি করিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, তারা তাদের দাবি পূরণ করাতে চায়। কিন্তু দাবিগুলো কী সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নাই।”

কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন “না, আমাকে কোনো টর্চার বা হ্যারাসমেন্ট…তবে মাঝে মাঝে এক-দুজন দুর্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু খুব সামান্য।”

প্রতিক্ষণে মৃত্যু ভয় কাজ করার কথা উল্লেখ করে আরেক প্রশ্নে জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা বলেন, “আমার মনে হয়েছে, আমরা কখনও ফিরতে পারব না বা বাঁচব না। যে কোনো বিপদসঙ্কুল মুহূর্তে তারা আমাদেরকে হত্যা করবে।

“কোনো অপারেশনের মাধ্যমে যদি আমাদেরকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়, তারা আমাদেরকে হত্যা করবে। হত্যা করে ওরা পালিয়ে যাবে।”

টানা ১৮ মাস পর মঙ্গলবারই পরিবারের সঙ্গে কথা হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “পরিবারের সাথে আমার গতকালই (মঙ্গলবার) একমাত্র কথা হয়েছে। দেড় বছর পরে গতকালই আমি বদরুল আহমেদের টেলিফোন থেকে কথা বলেছি।”

যুদ্ধবিধ্বস্ত এমন কোনো দেশে কাজে ফেরার ইচ্ছা এখনও আছে কি না- এমন প্রশ্নে অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলেন, “আপনি যদি বলেন, এই ধরনের বিপদসঙ্কুল কাজে আমি যাব কিনা…আমি একজন প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা। আমার কাজই এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং কাজে যাওয়া। দেশের প্রয়োজনে আমি পিছপা হব না।”

উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, “আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করতে চাই তার কথা, যার নির্দেশে আমাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।”

এ বিষয়ে এক প্রশ্নে সুফিউল আনাম বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ যে প্রয়োজন, আমি এটা বুঝতে পারি নাই।

“আমি কালকে পৌঁছানো পর্যন্ত আমি জানতামও না যে, বাংলাদেশ থেকে আমাকে উদ্ধার করার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং উদ্যোগ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না।”

উদ্ধার প্রক্রিয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এই প্রসেসটা খুব ডেলিকেট একটা প্রসেস। আপনারা জানেন যে, আমি খুব ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী দলের অপহরণের শিকার হয়েছিলাম এবং বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর।

“আমি নিরাপত্তার স্বার্থে এ বিষয় বর্ণনা করতে অপারগ। আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না এজন্য। আপনারা জানেন যে, এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য যদি তাদের অপছন্দ হয়, তারা আমাকে খুঁজে বের করবে, তাড়া করবে। তো, আমি এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ভুগতে চাই না। আশা করি, আপনারা এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।”

 

এএম/

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন