বরখাস্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাচ্ছেন সেই দুদক কর্মকর্তা
ন্যায় বিচার পেতে হাইকোর্টে যাচ্ছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরখাস্ত হওয়া উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতায় অপসারণকে অসাংবিধানিক দাবিও করেছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি প্রভাবশালীদের হুমকিতে আছেন বলে জানান।
শুক্রবার রাতে (১৮ ফেব্রুয়ারি) একটি গণমাধ্যমের কাছে এমনটাই দাবি করেন তিনি।
শরীফ উদ্দিন জানান, আমি প্রথমে আমার বিরুদ্ধে করা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে আদেশ রিভিউ আবেদনের চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, আমি হাইকোর্টে আপিল করব এই বলে, আমাকে যে চাকরি বিধি অনুযায়ী অপসারণ করা হয়েছে, সেটা অসাংবিধানিক। যা সংবিধানের ১৩৫ আর্টিকেলকে কাভার করে না। আমি সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমি সেই অধিকার পাওয়ার জন্য আপিল করব।
অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দাবি করে তিনি বলেন, দুদকে আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ দিয়েছে তারা সবাই আসামি। যাদের গ্রেপ্তার করেছি। আমার কথা হলো আসামি বাঁচার জন্য আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিবেই, সেজন্য সত্যতা যাচাই না করেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে? আমাকে আটকাতে পারলে আসামিদের লাভ। কেননা তখন আর তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আমাকে সাসপেন্টের দুই মিনিটের মাথায় আমার আইডি কার্ড জোড় করে নিয়ে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার কাছে অফিসিয়াল কিছু নেই এই মর্মে অমানবিকভাবে আমার কাছ থেকে হলফনামা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি কষ্টের।
শরীফ বলেন, পটুয়াখালীর সজেকায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে আমি ১০০ কোটি টাকার মালিক। অথচ আমি সেখানে মাত্র ৮ মাস ছিলাম। তাও ওএসডি অবস্থায়। কোনো অনুসন্ধান ও তদন্তের ফাইল আমাকে দেওয়া হয়নি। আমি ১০০ কোটি টাকা কিভাবে আয় করলাম? বর্তমানে গুম আতংকে আছি। এর আগেও পরিবারসহ হত্যা হুমকিতে থানায় জিডি করতে হয়েছে আমাকে।
সংবিধানের ১৩৫ ধারার উপধারা-(১) বলা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের কর্মে অসামরিক পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ-অপেক্ষা অধঃস্তন কোনো কর্তৃপক্ষের দ্বারা বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত হবেন না।
উপধারা-(২) অনুরূপ পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত তাকে বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাবে না। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফা সেই সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, যেখানে- (অ) কোনো ব্যক্তি যে আচরণের ফলে ফৌজদারী অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন, সেই আচরণের জন্য তাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা হয়েছে; অথবা (আ) কোনো ব্যক্তিকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো কারণে- যাহা উক্ত কর্তৃপক্ষ লিপিবদ্ধ করবেন- উক্ত ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্ভব নয়। অথবা (ই) রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ব্যক্তিকে একই সুযোগদান সমীচীন না।
উপধারা-(৩) এ বলা হয়েছে, অনুরূপ কোনো ব্যক্তিকে এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্ভব কি না, এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সেই সম্পর্কে তাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। (৪) যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি কোনো লিখিত চুক্তির অধীন প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন এবং উক্ত চুক্তির শর্তাবলী-অনুযায়ী যথাযথ নোটিশের দ্বারা চুক্তিটির অবসান ঘটানো হয়েছে, সেই ক্ষেত্রে চুক্তিটির অনুরূপ অবসানের জন্য তিনি এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে পদ হইতে অপসারিত হয়েছেন বলে গণ্য হবে না।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।
অপসারণের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার পর দুদকের প্রধান কার্যালয়সহ ২১ জেলায় মানববন্ধন করে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর আগে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করেন তারা। যেখানে প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বাক্ষর রয়েছে বলে জানা গেছে।
সচিবের কাছে পেশ করা স্মারকলিপিতে প্রধান বিষয় ছিল-অসাংবিধানিকভাবে ও বিজ্ঞ আদালতে বিবেচনাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর বিতর্কিত ৫৪ (২) ধারার উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দীনকে চাকরি হতে অপসারণের আদেশ বাতিল করার দাবিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সস্মারকলিপি।
অপসারণ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৪ ও দুদক চাকরি বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী দুদকের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। অপসারণ হওয়া দুদকের উপ-সহাকরী পরিচালক মো. শরীফ চাকরি বিধিমালা যে সকল বিধি মানা প্রয়োজন সেগুলো না মেনে অব্যাহতভাবে বিধির পরিপন্থি কাজ করে যাচ্ছিল। দুদক মনে করেছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে ও সকল কর্মকর্তারা সঠিকভাবে কাজ করেন, সেলক্ষ্যে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়, এটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষারও বিষয়। দুদক আইন ও চাকরি বিধিমালা যাতে সবাই মেনে চলে, সে লক্ষ্যেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শরীফ উদ্দিন পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম-২ এর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। গত বছরের ১৬ জুন চট্টগ্রাম থেকে তাকে পটুয়াখালী বদলি করা হয়।
চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে বেশ কিছু বড় দুর্নীতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মো. শরীফ উদ্দিন। এরপরই একাধিক মহলের রোষানলে পড়েন বলে অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি পরিবারসহ হত্যার হুমকি পান শরীফ উদ্দিন। হুমকি পাওয়ার পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরী ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সিসি টিভির ফুটেজসহ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।
কক্সবাজারে কয়েকটি মেগা প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাৎ, চট্টগ্রাম মেডিকেলে অনিয়ম-দুর্নীতি, কর্ণফুলী গ্যাসে নিয়োগ দুর্নীতি, এনআইডি জালিয়াতি, রোহিঙ্গাদের ভোটার করা নিয়ে দুর্নীতি, ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ গোপন ইত্যাদি। এসব মামলার সূত্র ধরেই আলোচনায় আসেন শরীফ।
মুক্তা মাহমুদ