খালিস্তান বিতর্কে ‘বাণিজ্য মিশন’ স্থগিত করল ভারত-কানাডা
ভারতীয় উপমহাদেশের শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য কথিত পৃথক রাষ্ট্র খালিস্তান বিতর্ক নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ‘বাণিজ্য মিশন’ নামের বহুল প্রতীক্ষিত বাণিজ্যচুক্তি স্থগিত করেছে ভারত এবং কানাডা। শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুই দেশের কর্মকর্তারা নিজ নিজ সরকারের পক্ষে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শুক্রবার কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজির মুখপাত্র শান্তি কনসেনটিনো কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ, এ মুহূর্তে আমরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য মিশন স্থগিত করছি। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীর ভারত সফরও মুলতবি করা হয়েছে।’
শান্তি কনসেনটিনো এ মন্তব্য করার কয়েক ঘণ্টা আগে সংক্ষিপ্ত এক বিবৃতিতে একই তথ্য জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর আগে গেলো মে মাসে কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজি এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পীযুষ গয়াল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিলেন, চলতি ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই স্বাক্ষরিত হবে ‘বাণিজ্য মিশন’। এ চুক্তি স্বাক্ষর হলে দুই দেশের পারস্পকির বাণিজ্য ও বিনিয়োগক্ষেত্রে রীতিমতো উল্লম্ফণ ঘটবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন তারা।
প্রসঙ্গত, নিজেদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের আওতা বাড়ানো এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে একটি চুক্তি করা নিয়ে কানাডা ও ভারতের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। তারপর দীর্ঘ এক দশক অবশ্য সেই আলোচনায় তেমন গতি পরিলক্ষিত হয়নি; তবে গেলো দু’তিন বছর ধরে ফের শুরু হয়েছে এ সম্পর্কিত আলোচনা।
গেলো ৯-১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-২০ জোটের সম্মেলন। জোটের অন্যতম সদস্যরাষ্ট্র কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এসেছিলেন বিশ্বের প্রধান এ অর্থনৈতিক জোটের সম্মেলনে।
কানাডার সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা আশা করেছিলেন, জি-২০ সম্মেলনের অবসরে জাস্টিন ট্রুডোকে আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আমন্ত্রণ জানাবেন ভারতের প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই বৈঠকে সম্ভাব্য সেই চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা হবে। তারপর অক্টোবরে কানাডার বাণিজ্যমন্ত্রী মেরি এনজি ভারত সফরে যাবেন এবং সেই সফরে সাক্ষরিত হবে বাণিজ্য মিশন।
কিন্তু সম্মেলনে পর্যাপ্ত অবকাশ ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ট্রুডোকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আমন্ত্রণ জানাননি মোদি। উপরন্তু, ট্রুডোর সঙ্গে একান্তে কথা বলার সময় তিনি কানাডার খালিস্তানপন্থী শিখদের আন্দোলন নিয়ে ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করেছেন বলে জানা গেছে।
‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই আচরণকে তিরস্কার হিসেবে বিবেচনা করেছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন,’ আলজাজিরাকে বলেন কানাডার এক সরকারি কর্মকর্তা।
তারপর শুক্রবার সকালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কানাডার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আপাতত বাণিজ্য মিশন চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।’
এ বিবৃতি দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আগামী মাসে মেরি এনজের সম্ভাব্য ভারত সফর স্থগিত করল কানাডা। খালিস্তান সংকট ‘খালিস্তান’ নামটি এসেছে পাঞ্জাবী ভাষার শব্দ ‘খালসা’ থেকে, যার অর্থ ‘পবিত্র’। তাই খালিস্তান শব্দটির আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ ‘পবিত্র ভূমি’। ১৬৯৯ সালে শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগুরু গোবিন্দ সিং প্রথম শিখদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্রের দাবি তোলেন। সেই রাষ্ট্রের নাম তিনি দেন খালিস্তান।
গোবিন্দ সিংয়ের প্রস্তাবিত সেই রাষ্ট্রের সীমানা ছিল ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে পাকিস্তানের লাহোর পর্যন্ত। এই এলাকার মধ্যে পড়া তিনটি অঞ্চল— অখণ্ড পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লি নিয়ে খালিস্তান গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের পাশাপাশি শিখরাও খালিস্তানের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। সেই আন্দোলন সফল হয়নি। তবে গেলো শতকের সত্তর ও আশির দশকে ভারতে তীব্র হয়ে ওঠে খালিস্তান আন্দোলন। এমনকি এ আন্দোলনের জেরে নিজের নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে ১৯৮৪ সালে খুন হতে হয় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। ভারত-কানাডা দ্বন্দ্ব গেলো জুন মাসে কানাডা ও ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওটিতে দেখা যায়, কানাডার অন্টারিও প্রদেশের ব্রাম্পটন শহরে কুচকাওয়াজ করছেন এক দল শিখ তরুণ এবং সেই কুচকাওয়াজের থিম সাজানো হয়েছে ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে।
এই ভিডিওচিত্র প্রকাশের পর কানাডার প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, কানাডার সরকার ভারতের সেই সব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে, যারা নিয়মিত বিদেশে ভারতের কূটনীতিবিদ ও প্রবাসী ভারতীয়দের ওপর হামলা চালানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।’
জবাবে পাল্টা এক বিবৃতিতে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘কানাডার সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির অধিকার স্বীকৃত। কোনো ব্যক্তি বা জনসমষ্টি যদি সাংবিধানিক শর্ত মেনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেন, সেক্ষেত্রে সরকার তাতে বাধা দিতে পারে না।’