আর্কাইভ থেকে জাতীয়

ঢাকার আশেপাশে বারবার ভূমিকম্প, কোন সতর্কবার্তা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবারও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে এবং এ নিয়ে চলতি মাসেই মোট তিনটি ভূমিকম্প অনুভূত হলো বাংলাদেশে।

ঢাকায় আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে রোববার দুপুরে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিলো রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ২ এবং এর উৎপত্তিস্থল ছিলো ঢাকা থেকে ৬০ কিলোমিটার দুরে টাঙ্গাইলের একটি এলাকায়।

যদিও উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিভ্রান্তিও রয়েছে। কারণ মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল এলাকায়।

ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যও বলছে, এর উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইল। কিন্তু দুটোর যেখানেই হোক-উভয় স্থানই রাজধানী ঢাকার কাছে।

ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন ভূমিকম্পের সম্ভাব্য দুটি উৎসই ঢাকার দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে এবং এ ছাড়া ঢাকার পাশ্ববর্তী কয়েকটি এলাকায় ভূমিকম্পের ইতিহাসও আছে।

বিশেষ করে সিলেট এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল- এসব এলাকায় বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে সেটাই হবে ঢাকার জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকার কাছে ভূমিকম্প নতুন নয়

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে মাঝে মধ্যেই যেসব ভূকম্পনগুলো অনুভূত হয়, যার উৎস সাধারণভাবে বাংলাদেশের বাইরে এবং এই শহর থেকে ২০০/৩০০ কিলোমিটার দূরে।

অনেকগুলো ভূমিকম্পের মূল কেন্দ্র ছিল পূর্ব দিকে মিয়ানমার অথবা ভারতের মিজোরাম, মনিপুর এবং উত্তরে আসাম, নেপাল কিম্বা ভুটানে।

কিন্তু এর মধ্যেই অনেক ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়েছে যার উৎসস্থল ছিলো ঢাকার কাছাকাছি এলাকাগুলোতেই।

অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন যে গত পনের কিংবা বিশ বছরের মধ্যে এমন কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে যেগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিলো ঢাকার আশেপাশের কয়েকটি জেলা, যার মধ্যে আছে- নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকা।

এর মধ্যে শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জে ৫.১ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের কথাই বলে থাকেন গবেষকরা।

এছাড়া ফরিদপুর থেকেই গত দেড় দশকের মধ্যে অন্তত দুবার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

তিন বছর আগে, ২০২০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।

এছাড়া ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে এবং ২০১৯ সালে মির্জাপুরে চার মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছে বলে বলছে আর্থকোয়েকট্র্যাক।

এছাড়া চলতি বছরের মে মাসেই ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিলো যার উৎপত্তিস্থল ছিলো ঢাকার দোহার থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি থাকায় তখনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন গবেষকরা।

ওই একই স্থান হতে ২০১২ সালের ১৮ই মার্চ ৪.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল।

আখতার বলছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট ভূমিকম্পের একটি উৎস।

ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল বিশেষ করেন টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের লালমাটি থেকে যমুনার পললভূমি- যেটা ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত, এই পুরো ৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ফল্ট।

আর সম্প্রতি গত মাসেই আরও যে দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো যেগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিলো সিলেট অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায়।

কতটা ঝুঁকি কোথায়, ঢাকার কত কাছে

বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে।

এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।

সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোন বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।

যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ একটি গবেষণা করেছিলো এবং সে গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অঞ্চল, যেখানে দুটো প্লেটের সংযোগস্থল।

 

এখানে একটি প্লেট আরেকটার নীচে তলিয়ে যাচ্ছে। সেটি হলো – ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের হাওড় হয়ে মেঘনা নদী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বরাবর ওই প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে।

“গবেষণা বলছে এই সাবডাকশান জোনই হলো ভূমিকম্পের উৎস স্থল। আমাদের গবেষণা দেখা গেছে এই সাবডাকশান জোনে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় হয়ে আছে তার মাত্রা ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রা পর্যন্ত। সাধারণত বড় ধরণের ভূমিকম্পগুলো এমন জোনেই হয়। যেটা চিলি, আলাস্কা বা জাপানেও দেখা যায়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ অঞ্চলে ভূমিকম্পের আরেকটি উৎস হলো ডাউকি ফল্ট, যেটি শেরপুর থেকে শুরু জাফলং হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে বিস্তৃত। বিশেষ করে এর পশ্চিমাংশ আরেকটা ভূমিকম্পের উৎস।

আর বাংলাদেশকে ঘিরে ভূমিকম্পের এ দুটি উৎস কাছাকাছি হলেও সাবডাকশান জোনটিই হলো ভয়ংকর, বলছেন মি. আখতার।

“এগুলো ঢাকা থেকে ৭০-১৫০ কিলোমিটার দূরে। যে কারণে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেটাতেই ঢাকার অবস্থা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে,” বলছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।

এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং এখানকার ভবনগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতা অনেক বেশি।

“কারণ শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত উপায়ে এবং সরকারের প্রস্তুতি ও জনসচেতনতার অভাব প্রকট। অর্থাৎ ঝুঁকির তীব্রতা বাড়াতে যা যা দরকার সবই ঢাকায় বিদ্যমান। এ কারণেই মনে হচ্ছে ভূমিকম্পগুলো ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে”।

কত বছর পর পর হয় ভূমিকম্প

বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন সাবডাকশন জোনে বড় আকারের দুটো ভূমিকম্পের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর।

ময়নামতি পাহাড়ে বৌদ্ধ বিহারের যে স্থাপনা ওই এলাকা থেকে লোকজন অভিবাসন করে চলে গেছে ৮০০ থেকে ১,০০০ বছর আগে। তাদের এই অভিবাসনের সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক ছিল।

"তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি এখানে যে শক্তি সঞ্চিত ছিল সেটা ৮০০ বা ১০০০ বছর আগে ছেড়ে দিয়েছে এবং নতুন করে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে," বলেন হুমায়ুন আখতার।

তাই আরেকটা বড় মাপের ভূমিকম্পের আশংকা আছেও বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস

বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় ১৫৪৮, ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৭৬২, ১৭৬৫, ১৮১২, ১৮৬৫, ১৮৬৯ সালে ভূমিকম্প হওয়ার ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এসবের মাত্রা কত ছিল তা জানা যায় না।

এছাড়া ১৮২২ ও ১৮১৮ সালে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ৭.৫ ও ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। অবশ্য এর ক্ষয়ক্ষতির তেমন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

গবেষকদের মতে বাংলাদেশে গত ১২০-২৫ বছরে মাঝারি ও বড় মাত্রার প্রায় শতাধিক ভূকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে সাত বা তার চেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

যদিও বাংলাদেশ ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত এবং এর নিচে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে তা বের হলে বাংলাদেশে বেশ বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।

কীভাবে ভূমিকম্প পরিমাপ করা হয়?

মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল (Mw) নামে ভূমিকম্প পরিমাপ করার একটি স্কেল আছে। এটি এরআগে ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র হিসেবে পরিচিত রিখটার স্কেলকে প্রতিস্থাপন করেছে। রিখটার স্কেলকে এখন পুরানো এবং তেমন নির্ভুল নয় বলে বিবেচনা করা হয়।

ভূমিকম্পের যে সংখ্যাটি দেয়া হয়, তা দিয়ে ফল্ট লাইন কতটুকু সরেছে এবং যে গতি এই সরানোর পেছনে কাজ করেছে সেটি নির্দেশ করে।

২.৫ বা তার কম কম্পন সাধারণত অনুভূত হয় না, তবে যন্ত্রে ধরা পড়ে। পাঁচ মাত্রার কম্পন অনুভূত হয় এতে সামান্য ক্ষতি হতে পারে। ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প বেশ শক্তিশালী বলে ধরা হয় এবং এতে মারাত্মক ধরণের ক্ষতি সাধিত হয়। যেমনটি তুরস্কে এবার হয়েছে।

৮ মাত্রার বেশি কোন ভূমিকম্প যে কোনো কিছুর ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে এবং এর কেন্দ্রে থাকা কমিউনিটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে।

তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন