মার্কিন ভিসানীতিতে সরকার কী চাপে রয়েছে?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত করতে বাংলাদেশিদের ওপর ভিসানীতি বাস্তবায়ন শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত’ কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়ে গত শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার ওই বিবৃতিতে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকায় বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যরাও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন।
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের এই ঘটনা বর্তমানে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে সরকার চিন্তিত নয়।
বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, এই ভিসানীতি প্রয়োগে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না। বিএনপি বলছে, ভিসানীতি প্রয়োগ বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। আর এর জন্য সরকারই এককভাবে দায়ি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনে প্রভাব বা দেশের জন্য লজ্জার-যে যাই বলুক না কেন বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভিসা নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের সব ব্যবস্থা করা। নতুবা পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে।
শনিবার(২৩ সেপ্টেম্বর)ন কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সা্ক্ষাতকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘মার্কিন ভিনাসীতি নিয়ে বাংলাদেশ চিন্তিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশ, তেমনি আমরাও। বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) অবশ্যই অন্যদের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু আমরা এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ আমরা জানি কিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হয়।’
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কড়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞায় কিছুই যায় আসে না। এমনকি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন, ব্যবসা করেন। তার সম্পদও যদি যুক্তরাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করে তাতেও কিছু আসে যায় না।
ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, "আমি আশা করি, বিরোধী দলসহ নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টাকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।” আমরা জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। কে নিষেধাজ্ঞা দেবে বা দেবে না তা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।'
তবে ভিসানীতি প্রসঙ্গে শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন,"যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক ও লজ্জাজনক। এজন্য বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর কোনো দায় নেই। সরকারই এককভাবে দায়ী।”
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন বিশ্বে গণতন্ত্রের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘ যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে সামনে রেখে কাজ করলেও তাদের মূল বিষয় হলো ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় তাদের অবস্থান এবং নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া। এই দুটি বিষয়ে পুরোপুরি আশ্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত ঢাকার ওপর নানা ধরণের চাপ বাড়াবে ওয়াশিংটন। ভিসা নীতি কার্যকর যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে দেশটি একটা মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করছে। নিষেধাজ্ঞাকে তারা বেশ কার্যকর মনে করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক মনে করেন, সরকার অবশ্যই চাপ কমানোর চেষ্টা করছে।
তবে অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামানের এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বায়ান্ন টিভিকে তিনি বলেন,“ভিসানীতি একটি দেশের সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা এই ভিসানীতি করেছে। নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে যারা চাইবেন তাদের ওপরইতো এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা। তাই ভিসা নীতি প্রয়োগে সরকারের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ সরকারও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাতো বলেই দিয়েছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। তাই ভিসানীতি নিয়ে সরকার কোনো চাপে নেই বলে আমি মনে করি।’
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পর ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশও একই ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে এমনটা মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান। তার মতে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের পর অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরে যাওয়া তাই প্রমাণ করে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পর বন্ধুপ্রতিম দেশ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানও একই ধরণের উদ্যোগ নিতে পারে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান এ বিষয়ে বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘মূলত যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হোক। সরকারও চাইছে সেটা। এতে সরকার চাপে রয়েছে বলে আমি করি না। যারা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে চাইবেন, তাদের জন্য এই ভিসানীতি উদ্বেগজনক। নির্বাচন ইস্যুতে সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া পাওয়া যেহেতু এক, তাই সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি অন্যান্য দেশগুলো একই সিদ্ধান্ত নেবেনা বলেও তিনি মনে করেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আগেই আমাদের সতর্ক করেছে। তারা মে মাসের ২৪ তারিখ এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। আসলে তখন থেকেই তারা কাজ শুরু করেছে। তারপরও যদি আমরা ব্যবস্থা না নিই। আমাদের মতো আমরা কাজ করেই গিয়ে থাকি, তাহলে তারা এখন সেকেন্ড সিগন্যাল দিচ্ছে যে তারা তাদের ভিসা নীতি কার্যকর শুরু করেছে। এই সময়ে তারা কে কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে, তার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে। তারা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে, যে সামনে তারা এটা নিয়ে তাদের কাজ অব্যাহত রাখবে।’
বাংলাদেশের এই পেশাদার কূটনীতিক আরো বলেন, ‘ আমরা যদি এখন সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা না করি তাহলে এটা আমাদের জন্য জটিলতা আরো বাড়াবে। কারণ এখানে তো শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, দুইদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবেনা। তাদের সঙ্গে পুরো পাশ্চাত্য জগত। এগুলো যদি আমরা ধর্তব্যের মধ্যে না নিই তাহলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। দেশের মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। তাই নির্বাচনটা নির্বাচনের মতো হওয়া উচিত।