কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
মুসলিম রেনেসাঁর কবি তিনি। তার কবিতা তৎকালীন বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা জোগায়। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহার ক্লিষ্টের করুণ পরিণতি, সমকালের সংকট, জরাগ্রস্ত বাস্তবতা এবং সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতা দেখে তিনি দগ্ধ হতেন। আর এ সকল অসঙ্গতি-ই তাকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রেরণা জোগায়। বলছিলাম আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদের কথা।
আজ ১৯ অক্টোবর, তার ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৪ সালের এই দিনে ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে বাংলা সাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় এই কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফররুখ আহমদ আধুনিক বাংলা কবিতার প্রখ্যাতকবি। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতার প্রকরণকৌশল ও শব্দচয়ন ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার নানান সৌকর্য তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতায় ফররুখ আহমদের সৃষ্টিশীলতা মৌলিক বলে সর্বজন স্বীকৃত।
ফররুখ ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
‘কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে? এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী। তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে; সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি। রাত পোহাবার কত দেরি, পাঞ্জেরি?’
কবির কলম অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিল। জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কবি মানবতা ও সাম্যের জয়গান গেয়েছেন। কবিতায় লিখেছেন— ‘লোহুতে পার্থক্য নাই বণি আদমের শিরায় শিরায় আর ধমনীতে দেখি বহমান এক রক্ত ধারা।’
ফররুখ ছিলেন স্বাধীনচেতা, আত্ম মর্যাদাবান ও অতি উঁচু মাপের আধুনিক কবি। পশ্চিমা আধুনিক কবিদের রচনার আঙ্গিক ও বিশুদ্ধতা তার কবিতায় দৃশ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ, আইয়ুব শহীর বিরুদ্ধের গণআন্দোলন প্রভৃতি সব স্তরে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যবহারে ফররুখ ছিলেন অনন্য। কবি লিখেছেন— ‘রাত্রির অগাধ বনে ঘোরে একা আদম-সুরত তীব্রতর দৃষ্টি মেলে তাকায় পৃথিবী জাগো জনতার আত্মা ওঠো, কথা কও। কতকাল আর তুমি ঘুমাবে নিসাড় নিস্পন্দ।’
কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। মাতা বেগম রওশন আখতার। তিনি ছিলেন সাম্যের কবি, দারিদ্র্যের কবি ও নিপীড়িত মানবতার কবি। স্বধর্ম আর স্বজাতির প্রতিও কবির অনুরাগ ছিল অগাধ। তবে এই অনুরাগ বা ভালবাসা কবিকে কখনও বিশ্বমানব কল্যাণ কামনায় বিরত করেনি।
তিনি ১৯৩৭ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হলেও পরীক্ষা না দিয়েই তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৫ সালে মাসিক ‘মোহাম্মাদী’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও স্থায়ীভাবে চাকরি করতেন ঢাকা বেতারে। ১৯৪২ সালের নভেম্বরে খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন লিলিকে বিয়ে করেন তিনি।
সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও ফররুখ আহমদের কবি পরিচিত ছিল প্রধান। তার রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। তার উল্লেখযোগ্য কাব্য সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), হাতেমতায়ী (১৯৬৬) ইত্যাদি। পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ইত্যাদি তার শিশুতোষ রচনা।
তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরম্যান্স (১৯৬১), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেসকো পুরস্কার (১৯৬৬), মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) লাভ করেন।