ইসরায়েলে হুথি বিদ্রোহীদের হামলা, যা বলছেন বিশ্লেষকেরা?
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হামলার জবাবে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যাকায় এখনও বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।প্রায় একমাস পূর্ণ হতে চলেছে ইসরায়েল বনাম হামাসের লড়াই।এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতে হামাসের সমর্থনে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে লেবাননের প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহ’র যোদ্ধারা। গাজায় ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মিত্র হিজবুল্লাহ। গত ৭ অক্টোবর হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর লেবানন সীমান্ত থেকে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারাও ইসরায়েলে গোলা হামলা চালাচ্ছে।
লেবাননের হিজবুল্লাহর পর এবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের পক্ষে অস্ত্র ধরেছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। গাজায় বর্বর হামলার প্রতিবাদে গত ১০ অক্টোবর এবং ৩১ অক্টোবর ইরান-সমর্থিত ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথি ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় লোহিত সাগরের তীরবর্তী শহর ইলাতে। ইয়েমেনের হুথি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী আব্দেলআজিজ বিন হাবতৌর ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে ইসরায়েলে হুথিদের ড্রোন হামলার তথ্য নিশ্চিত করেন।
ইসরায়েলের প্রভাবশালী গণমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলাতের আকাশে মনুষ্যবিহীন যানের অনপ্রবেশ শনাক্ত করা হয়েছে।পরে ইলাতের বাসিন্দাদের সতর্ক করে দিতে বিমান হামলার সাইরেন বাজানো হয়। ইলাত শহরটি জর্ডান এবং মিসর-উভয় দেশের সীমানার কাছে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত।অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে শহরটির দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী এই ড্রোন হামলার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে।গত দুই সপ্তাহ ধরেই ইসরায়েলে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার চেষ্টা চালায় ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। হামাসের সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায়ই হামলার চেষ্টা করেছে হুথি বিদ্রোহীরা। ইতিমধ্যে তাদের ছোড়া কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনে গুলি চালিয়ে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তেলআবিব ।
হিজবুল্লাহর পর হুথি বিদ্রোহীদের হামলার বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষকরা নানা মত পোষণ করছেন। তাদের অনেকের মতে,ইসরায়েলে মিসাইল ছুড়ে কাকে বার্তা দিচ্ছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা? মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলে তাদের এই হামলা কেন?
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,কয়েকদিন আগেই ইজরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় হুথি বিদ্রোহীরা।তবে সেগুলো ভূমধ্যমসাগরে নিয়োজিত মার্কিন রণতরীর নৌসেনারা ধ্বংস করে দেয়।
ভৌগলিক অব্স্থান থেকে ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলের দুরত্ব ২ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি।এমতাবস্থায় এতটা দূরে আঘাত করার মতো অস্ত্র বা মিসাইল নেই হুথি বিদ্রোহীদের। তাই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল হুথি বিদ্রোহীরা হয়তো তেলআবিবে আর হামলা করবে না।তবে গত ৩১ অক্টোবর ফের মিসাইল ছোড়ে হুথি বিদ্রোহীরা।তাই বিশ্লেষকদের অনেকের মনে প্রশ্ন-প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা জেনেও হুথি বিদ্রোহীরা কেন বারবার ইসরায়েলে হামলা চালাচ্ছে? রাজধানী সানার উপর চাপ বাড়িয়ে এক সময় সৌদি প্রশাসন ১০ লাখের বেশি ইয়েমেনি শ্রমিককে দেশ থেকে বের করে দেয়। যার ফলে বেকারত্ব আরও গ্রাস করেছে ইয়েমেনকে। ওইসময় এই দেশটির পাশে দাঁড়ায় ইরান।
২০১৪ সালে তখন শিয়াপন্থী হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের রাজধানী সানা এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ দখল করে নেয়। এরপর, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার দক্ষিণে পালিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবে নির্বাসিত হয়।
হুথিদের এই দখলের কয়েক মাস পর, সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট সেখানে হস্তক্ষেপ করে। আর, এই সংঘাত সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে একটি আঞ্চলিক ছদ্ম যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধে, বেসামরিক নাগরিক ও যোদ্ধাসহ দেড় লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে; আর, বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে দূর থেকে এই সংঘাতের বিষয়ে সৌদি আরবকে গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান করে। ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে। হুতি বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে ইরান। ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এখনও সামরিক অভিযান চালাচ্ছে সৌদি জোট।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন,ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের পক্ষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেও তাদের মূল টার্গেট তেলআবিব নয়। হুথিদের ইসরায়েলে হামলার কারণের পেছনে রয়েছে অন্য সমীকরণ।তাদের মূল টার্গেট সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রপন্থীরা।
তাদের ধারণা,এবার হুথি বিদ্রোহীদের ইসরায়েলে হামলার নেপথ্যেও রয়েছে ইরানের নির্দেশ। কারণ মার্কিন প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে উদ্যোগী হয়েছে রিয়াদ। তবে ওই উদ্যোগে বাধ সেধেছে হামাস-ইসরায়েলের লড়াই। ফলে ইরানের পরামর্শে ইসরায়েলে হামলার মাধ্যমে মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিতে চাইছে হুতি বিদ্রোহীরা। এভাবেই সৌদি আরবকে মুসলিম বিশ্বে কোণঠাসা করার ছক কষছে তেহরান বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, টাইমস অব ইসরায়েল, আলজাজিরা