ব্যাংকিং ও বীমা

পদ্মা ব্যাংক থেকে সরে গেলেন নাফিজ, কারণ কী?

অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডোবা ফারমার্স ব্যাংক ‘পদ্মা’ নামে যাত্রা শুরুর পাঁচ বছর পর পদত্যাগ করলেন এর চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

পুনর্গঠনের সময় পদ্মা ব্যাংকের নয়া সরকারি সংস্থার আমানত ফিরিয়ে দিতে না পেরে সেগুলোকে শেয়ারে রূপান্তরের প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে আলোচনার মধ্যেই ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণ দেখিয়ে তিনি সরে গেলেন।

চৌধুরী নাফিজ সরাফাত একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমার একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে, পুরোপুরি সুস্থ হতে আমার বেশ কয়েক মাস সময় লাগবে। তাই ব্যাংকের কার্যক্রম যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে কারণে আমি সরে দাঁড়িয়েছি। চিকিৎসকেরা আমাকে দীর্ঘ সময় বিশ্রামে থাকতে বলেছেন।’

অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে।

সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।

পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।

এরপর ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে পদ্মা ব্যাংক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে ব্যাংকটি। বলা হয়, কোম্পানিটির ৭০ কোটি ডলার (৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ আনতে ব্যাংক মধ্যস্থতা করবে। ২ সেপ্টেম্বর ডেল মরগানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে পদ্মা ব্যাংক। অনুষ্ঠানে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ডেল মরগানের চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো উপস্থিত ছিলেন।

এই বিনিয়োগ আনার স্বার্থে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটিকে বেশ কিছু নীতি ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৯০০ কোটি টাকার বেশি লোকসানে থাকা ব্যাংকটিকে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে এ লোকসান না দেখানোর সুযোগও দেয়া হয়। লোকসানের বিপরীতে ‘ইনট্যানজিবল অ্যাসেট বা অদৃশ্য সম্পদ’ সৃষ্টি করার সুযোগ পায় পদ্মা ব্যাংক, যা পরের ১০ বছরের মুনাফা থেকে সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া লোকসান সমন্বয়ের সময়সীমা পর্যন্ত ১০ বছর ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেই বিনিয়োগ আর আসেনি।

এর আগেও ব্যাংকটিকে বেশ কিছু নীতি ছাড় দেয়া হয়েছিল। নগদ সংরক্ষণ বা সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রিকয়ারমেন্ট) ও বিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআরের (স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও) অর্থ জমা রাখার বাধ্যবাধকতায় ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মওকুফ করা হয় দণ্ড-সুদ ও জরিমানা।

২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা।

বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। ফলে ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকটি বড় অর্থের লোকসান গুনছে বলে জানা গেছে। এখন সরকারি খাতের ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর ও নতুন ঋণ দিয়ে ব্যবসা বাড়ানোতেই সমাধান খুঁজছে ব্যাংকটি।

অর্থাৎ নাফিজ সরাফাতের সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা।

সাবেক ব্যাংকার ও সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার চৌধুরী নাফিজ সরাফাত মোবাইলের টাওয়ার কোম্পানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি, তারকা হোটেল ব্যবসা, গণমাধ্যমসহ নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তার স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শহীদ বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক।

গেলো ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাড়ায় ছয় হাজার ১৪১ কোটি টাকা। এই আমানতের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) আমানত মোট এক হাজার কোটি টাকা।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন