জাতীয়

পরিমল, সুফিয়ানের পর মুরাদ সরকার, এরপর...

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের অন্যতম শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তবে এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখায় ঘটেছে একাধিক যৌন হয়রানির ঘটনা। সেই পরিমল জয়ধর থেকে শুরু করে বর্তমান মুরাদ হোসেন সরকার। এর মাঝে বসুন্ধরা শাখার ইংরেজি শিক্ষক আবু সুফিয়ানের কেলেঙ্কারিও যথেষ্ট সমলোচনার ঝড় তোলে। অভিভাবক ও সচেতন মহল বলছে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হতে পারে যৌন হয়রানি বন্ধের অন্যতম অস্ত্র। পাশাপাশি মুরাদ সরকারের কেলেঙ্কারি ঘটনা ধামাচাপা দিতে যারা সহায়তা করেছেন তাদের বহিষ্কারের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছে সচেতন অভিভাবক মহল।

মুরাদের কেলেঙ্কারিতে উত্তাল আজিমপুর: ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিতের সিনিয়র শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকার। এই শিক্ষক কোচিং করানোর সময় ছাত্রীদের যৌন নীপিড়ন করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার শাস্তি ও পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিক্ষোভ করার পর সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় এক শিক্ষার্থীর মায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন রাত ১২টার দিকে মুরাদকে কলাবাগানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বায়ান্ন টিভিকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘সোমবার সন্ধ্যায় এক শিক্ষার্থীর মায়ের করা যৌন নীপিড়ন মামলায় শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে তাকে আদালতে নেওয়া হয়।  পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুরাদকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

 ভিকারুননিসা স্কুলের আজিমপুর শাখার শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকার। সংগৃহীত ছবি

স্কুল সূত্রে জানা যায়, গত ০৭ ফেব্রুয়ারি ভিকারুননিসা স্কুলের আজিমপুর শাখার শিক্ষক মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে শাখা প্রধান সাবনাজ সোনিয়া কামালের মাধ্যমে অধ্যক্ষের কাছে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ করেন একাধিক অভিভাবক। পর দিন অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।

আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ বেগমকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানম ও ইংরেজি প্রভাতি শাখার শাখা প্রধান শামসুন আরা সুলতানা। তবে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ‘অস্বাভাবিক কালক্ষেপণ’ করেন বলে অভিভাবক মহলের অভিযোগ।  এনিয়ে  বিক্ষোভও করেন তারা।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ মূল শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অ্যাডভোকেট সারোয়ার জাহান চৌধুরী (শাকিল) ক্ষোভ প্রকাশ করে বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘যে তিনজন শিক্ষককে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা্ই মুরাদ হোসেন সরকারকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন। তাই আমরা এই তিনজনকে বহিষ্কারের পাশাপাশি তাদের বিচার দাবি করছি।’

গার্লস স্কুলে পুরষ শিক্ষক না রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরে অ্যাডভোকেট শাকিল আরও বলেন, ‘গার্লস স্কুলে পুরুষ টিচার থাকলে এ ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে। তাই আমরা অভিভাবকরা এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা রোধে শুধুমাত্র নারী শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাদানের পক্ষে।’ অস্থায়ী অধ্যক্ষের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে অধ্যক্ষ নিয়োগেরও দাবি জানান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের এই অভিভাবক।

প্রতিষ্ঠানটির আজিমপুর শাখায় অধ্যয়নরত ৬ষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ইফতেখার মোমিন বায়ান্ন টিভিকে বলেন, ‘মুরাদ হোসেন দীর্ঘিদিন ধরে কোমলমতি শিশুদের যৌন হয়রানি করে আসছেন। ওই শিক্ষক কোচিংয়ে পড়ানোর সময় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করতেন। ২০২৩ সালে এ ধরণের অভিযোগ উঠলে তিনি গভর্নিং বডিকে ম্যানেজ করে ঘটনা ধামাচাপা দেন। এর আগে ২০১৮ সালেও একই অভিযোগ ওঠে। পরে ওই অভিযোগ উল্টিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে নেন এবং অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেই আঙ্গুল তোলেন।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের এই অভিভাবক আরও বলেন, ‘মুরাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্যরাই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. ফারহানা খানম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট না দিয়ে কালক্ষেপণ করেছেন। তদন্ত করতে যেয়ে শিক্ষার্থীদের  ভয় দেখিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলোনোর চেষ্টা করেছেন। তাই আমরা মুরাদ এবং ড. ফারহানাসহ তদন্ত কমিটির তিন সদস্যের পার্মানেন্ট চাকুরিচ্যুতি চাই। পাশাপাশি মুরাদ ও তার সহায়তাকারী ওই তিন শিক্ষকের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

অভিভাবকদের বিক্ষোভ-কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে আজিমপুর শাখা থেকে প্রত্যাহার করে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এঘটনায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাতে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি আয়োজিত অনলাইন বৈঠকে মুরাদকে সাময়িক বরখাস্ত করার  সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিস থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

সবশেষ খবর, যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা  গণিত শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।ওই শিক্ষকের ৭ দিন রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিল পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মুরাদ হোসেন সরকারের রিমান্ড বিষয়ে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আদালত তা্র রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। অপরাধ করলে শাস্তি পাবেই। আদালতই তার ব্যাপারটি ফয়সালা করবে।’

মুরাদকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে বায়ান্ন টিভিকে কেকা রায় চৌধুরী বলেন, ‘দ্যাখেন সব কিছু একটা নিয়মের মধ্যে চলে। আমরা তাকে(মুরাদ) সাময়িক বরখাস্ত করেছি। আমাদের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মহোদয় অধিকতর তদন্তের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে দিয়েছেন। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দিবেন। এরপরই গভর্নিং বডি তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’

ইংরেজি শিক্ষক আবু সুফিয়ান

মুরাদ হোসেন সরকারের মতো একই ধরণের অভিযোগ ওঠে  ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার ইংরেজির শিক্ষক আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখার (দিবা) ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীও ওই শাখার ছাত্রী।

২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট ওই ছাত্রীর বাবা এ ব্যাপারে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার মেয়ে ভিকারুননিসা স্কুলের বসুন্ধরা শাখার নবম শ্রেণির দিবা শাখার ছাত্রী। ওই শাখার ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক আবু সুফিয়ানের কাছে সে প্রাইভেট পড়তো। প্রাইভেট পড়ানোর ফাঁকে ওই শিক্ষক বিভিন্ন সময় আমার মেয়েকে অশালীন এসএমএস পাঠিয়েছে। যেগুলো খুবই আপত্তিকর ও সম্মানহানিকর। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না। আমি এ ঘটনার প্রতিকার চাই।’

    বসুন্ধরা শাখার ইংরেজির বরখাস্ত শিক্ষক আবু সুফিয়ান। সংগৃহীত ছবি

তবে অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক আবু সুফিয়ান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, 'ভুল-ত্রুটি মানুষের হতে পারে। কিন্তু সেটাকে পুঁজি করে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন আমারই কিছু সহকর্মী।’

সবশেষ ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি শিক্ষক আবু সুফিয়ানকে বরখাস্ত করা হয়।

বাংলা শিক্ষক পরিমল জয়ধর

২০১১ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার বাংলার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ছাত্রী ধর্ষণের এ ঘটনায় বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৮ মে স্কুলের পাশে একতলা ভবনের একটি কক্ষে স্কুলটির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন পরিমল। এ ঘটনায় ওই বছরের ৫ জুলাই ওই ছাত্রীর বাবা বাড্ডা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় মামলা করেন। মামলায় পরিমল জয়ধর, স্কুলের ওই শাখার তৎকালীন অধ্যক্ষ হোসনে আরা ও বসুন্ধরা শাখার প্রধান লুৎফুর রহমানকে আসামি করা হয়।

                          যাবজ্জীবন  কারাদণ্ড পাওয়া আসামি পরিমল জয়ধর। সংগৃহীত ছবি

তদন্ত করে দোষী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এটি ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে ওই কুলাঙ্গারকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, কর্তৃপক্ষকেও করতে হয় জবাবদিহি। এ দেশে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

ওই বছরের ৭ জুলাই পুলিশ পরিমলকে গ্রেপ্তার করে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর পরিমলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। তবে হোসনে আরা ও লুৎফুর রহমানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সবশেষ ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে আরও ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

দেশের রাজধানী থেকে আনাচে-কানাচে পর্যন্ত ঘটছে প্রাইভেট টিউটরদের যৌন অপরাধের ঘটনা। দু-একটি অপরাধ প্রকাশ্যে আসলেও বেশিরভাগই থেকে যায় অন্ধকারে। অনেকটা সমাজ ও প্রভাবশালীদের ভয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবার যৌন হয়রানির বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সাহস পায় না। তাই শিক্ষকদের এধরণের কোনো কর্মকাণ্ড দেখলেই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রতিবাদ করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনে সর্বশেষ মাউশি অধিদফতর ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। তবে অধিদফতরের নির্দেশনা মেনে এখনও সব স্কুল-কলেজে এ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। কমিটি গঠন করার পর এবিষয়ে তৎপর হওয়া উচিত। অন্যথায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেড়ে যাবে পরিমল, আবু সুফিয়ান ও মুরাদ হোসেনের মতো বিকৃত মানসিকতার শিক্ষকদের সংখ্যা। এমনটাই মনে করছেন সচেতন অভিভাবক মহল।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন