বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়কর তাহলে কি শিক্ষার্থীদের ঘাড়েই চাপবে?
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।একটি আপিল নিষ্পত্তির রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এমনটাই বলছে। তবে শিক্ষার্থীদের ওপর এই করের বোঝা বর্তাবে না।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনও কর দেয় না। তাই কর বাবদ নতুন যোগ হওয়া এই খরচ মেটানোর প্রভাব ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের ওপর কেমন হবে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন।
যদিও অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি-সহ অন্যান্য আয় থেকে সমস্ত পরিচালন ব্যয়, বেতন ইত্যাদি মেটানোর পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকবে তার ওপর এই কর ধার্য হবে। তারপরও শিক্ষার্থীদের আশংকা, তাদের ওপর খরচের বোঝা বাড়িয়েই এই করের অংক সমন্বয় করা হবে।
শিক্ষার্থীরা কোনও ভাবেই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না কারণ তারা যে বেতন দিয়েছেন তা থেকে সামান্যও বাড়বে না বলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা আশ্বস্ত করলেও শিক্ষার্থীরা ওই আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছে না।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থী ফয়সাল মাহমুদ বলেন, “এই শংকা তৈরি হয় যে এরপর ‘হিডেন চার্জ’-এর দিকে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় একেক রকম ফি নেয়, এটা সামনের দিনে আরও প্রকট হবে।”
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাঞ্জিমুর রহমান রাফির মন্তব্য, “কর্তৃপক্ষ আসলে এই কর নিজেরা দিবে না। আগেও যে কোনও ধরনের খরচ ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন সরাসরিই জানালেন, শিক্ষার্থীদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই এর চাপ পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ওপর কর বসানোর সুযোগ থাকা উচিত নয় বলেই মনে করেন তিনি।
আপিল বিভাগের রায়ের পর সভাও করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা। রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এটি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
উচ্চশিক্ষার খরচ আরও বাড়বে?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০৭ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার খরচ নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা আছে আগে থেকেই। কর সংক্রান্ত রায়ের ফলে সেই খরচের সূচক আরও বাড়বে বলেই শিক্ষার্থীদের ধারণা।
একই রকম মত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি-র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের ওপর চাপটা বাড়বে। যেখানে সরকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করতেই হিমশিম খায় সেখানে এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে তদারকি করা সহজ কাজ নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর-খাজনা দেয়া উচিত কিন্তু যথাযথভাবে দেয় না তাদের ওপর নজরদারি বাড়ালে আয় বাড়ানোর জন্য এসব খাতে সরকারকে নজর দিতে হত না।’ তবে, এই কর আরোপের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেও কাজে লাগানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে বিদ্যমান ট্রাস্ট আইন-১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। এখন করের আওতায় আনার ফলে শিক্ষাখাত ব্যবসা খাতভুক্ত হয়ে যায় বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘সামাজিক কল্যাণমূলক খাতকেও আমরা ব্যবসায়িক খাতে পরিণত করছি।’
এই 'পরিণত করার প্রচেষ্টা'র কারণ হিসেবে তিনি বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ ও বিদেশি ঋণের চাপে অর্থের সংকটকে অন্যতম বলে মনে করেন অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন।
শিক্ষার্থীদের ওপর এই বোঝা চাপবে না সেটা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটা কী হবে, এমন প্রশ্নও রাখেন এই অধ্যাপক।
বাংলাদেশে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি নির্ধারণে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের কারও কারও অভিযোগ কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন ফি বা অন্য নামে বাড়তি টাকা এমনিতেই নেওয়া হয়। এবার সেটা আরও বাড়বে। ফলে, বেনামে করের অর্থ আদায় করা হলে তা তদারকি করার উপায় থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পক্ষে-বিপক্ষে আইনি লড়াই
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর ২০০৭ সালে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পুনর্নির্ধারণ করা হল।’
এনবিআর আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১০ সালের ১ জুলাই। এতে বলা হয়, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের উদ্ভূত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হল।’
এই প্রজ্ঞাপন দুটিকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে প্রায় অর্ধশত রিট করা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ওই রিটগুলো করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট প্রজ্ঞাপনগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল বা আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। সেই সাথে, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আয়কর আদায় না করতে এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই আপিলের শুনানি শেষেই কর দিতে হবে মর্মে রায় ঘোষণা করা হল।
ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন
সরকার এর আগে ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করেছিল। এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। টানা কয়েক দিন ধরে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
সেই ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মিঠু মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, “প্রয়োজনীয় খরচ করার পর কোনও বাড়তি অর্থ যদি থাকে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কাজে সেটা ব্যয় করার কথা। আরও বিভিন্ন ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও কাজে নিয়োজিত করার কথা।”
তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স হোক আর ভ্যাট হোক, সরকারিভাবে যখন টাকা নেওয়া শুরু হয় তখন আর সেটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান থাকে কি না সেটাই প্রশ্ন।’
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'লাগামটাই এখনো ঠিকমতো ধরতে পারে নাই। এমন পরিস্থিতিতে করের টাকা কর্তৃপক্ষ তার নিজের আয় থেকেই দিবে, এটা নিশ্চিত করা কখনও সম্ভব না।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা