আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

৯ মাসে উঠে আসবে পদ্মা সেতুর খরচ

অনেক প্রতীক্ষার পর গেলো শনিবার (২৫ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আজ রোববার (২৬ জুন) সকাল থেকেই শুরু হয়েছে এই সেতুতে সব ধরনের যান চলাচল। সকাল থেকে প্রথম ৮ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ২০০টি গাড়ি চলাচল করেছে এই সেতুতে। এসব গাড়ি থেকে টোল আদায় করা হয়েছে ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা। ধারনা করা হচ্ছে আগামী ৩১ বছরে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে নির্মাণ খরচের ৫ দশমিক ৫ গুণ। আর জিডিপি বিবেচনায় মাত্র ৯ মাসে উঠে আসবে এই সেতুর খরচ।

পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই বিশাল বিনিয়োগের প্রাপ্তি হিসাবের দুটি উপায় আছে। একটি হলো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি বিবেচনা। আর অন্যটি সেতু দিয়ে পারাপার হওয়া বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায়। পদ্মা বহুমুখী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনার কাজ পেয়েছে কোরিয়া ও চীনের দুটি কোম্পানি। যৌথভাবে কাজটি পরিচালনা করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টোলের বেশিরভাগ টাকা দিয়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ করা হবে। বাকিটা খরচ হবে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে।

অর্থনীতি ও জিডিপিতেও  পদ্মা সেতু মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। ধারণা করা হচ্ছে এই সেতুর ফলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু কোন উপায়ে কত বছরে এই সেতুর ব্যয় উঠে আসতে পারে সে বিষয়ে সরকারিভাবে এখনো সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।

ধারণা করা হচ্ছে, এই সেতু দিয়ে দেশের ২৩ জেলায় প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৬০০। এসব যান থেকে টোল বাবদ যে টাকা আয় হবে, তা দিয়ে সেতুর ব্যয় উঠে আসতে সময় লাগবে সাড়ে ৯ বছর।

অন্যদিকে সেতু চালু হওয়ার কারণে আগামী এক বছর বা ১২ মাসে অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি যোগ হবে চলতি বাজার মূল্যে ৪২ হাজার ৩৬২ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এই টাকা জিডিপির ১.২ শতাংশের সমান। জিডিপি বিবেচনায় মাত্র ৯ মাসে উঠে আসবে ৩১ হাজার ৭৭১ কোটি ৬৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা। অর্থাৎ অর্থনীতিতে মাত্র এই ৯ মাসের প্রাপ্তি হবে পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের সমান।

আইসিএবি, ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকা্উনেন্টেড বাংলাদেশ এক প্রবন্ধে বলেছে, পদ্মা সেতু হলে আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ এবং ১০ বছরে ওই সব জেলায় ৩০-৪০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় আগামী ১০ বছরে ৫০০-১০০০ নতুন কারখানা স্থাপন হবে। এই সুবাদে দেশের অর্থনীতিতে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে । এই সেতু চালু হওয়ার পর ভারত ও নেপাল থেকে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে। পর্যটনশিল্পেও বিপ্লব ঘটবে। সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ। জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমবে।

বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি উপকৃত হবে  ৩ কোটি মানুষ। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিতের পাশাপাশি কমবে উৎপাদন খরচ। ফলে বিকাশ ঘটবে কৃষিভিত্তিক শিল্পের। এ সেতু হওয়ায় ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার যোগাযোগ আরও সহজ হবে । এসব অঞ্চলের মানুষ এই সেতুকে অর্থনৈতিক করিডর হিসাবে ব্যবহার করলে আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রায় । সেতুটির ফলে সরাসরি সড়ক ও রেলসংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে মোংলা, পায়রা, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কসহ ভারতের সাত প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যাতায়াতের সময় ও দূরত্ব কমবে।

এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক, এডিবির মতে আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যা নির্মাণ খরচের ৫ দশমিক ৫ গুণ। এ ছাড়া সামাজিক অগ্রগতি অর্থনীতিতে যোগ করবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। দুই পারে নদী শাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ইন্টারনেট লাইন বাবদ সাশ্রয় হবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে যে টাকা এই সেতুতে খরচ হয়েছে তা আগামী ৩০ বছরে সুদসহ অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেওয়া যাবে।

উল্লেখ্য, চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৩৫ বছরে সুদসহ ৩৬ হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। ঋণ রিপেমেন্ট শিডিউল অনুযায়ী প্রথম বছরেই ৫৯৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আবার কোনো কোনো বছর পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পর্যন্ত। গেলো ১৭ মে পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা করছে, প্রথম বছরে টোল আসবে ১ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা।

মির্জা রুমন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন