নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা তলানিতে, ইসরাইলজুড়ে পদত্যাগ দাবি
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এবার ক্ষেপেছেন তার দেশবাসী। সারাদেশে নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে জোর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। গাজায় প্রলয় সৃষ্টিকারী ইসরাইলি যুদ্ধের ছয় মাসে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, তিনি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এ যুদ্ধকে সামনে টেনে এনেছেন। একই সঙ্গে তিনিই হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে বাধা সৃষ্টি করছেন। ফলে গাজায় আটক থাকা জিম্মিদের ফেরত আনা যাচ্ছে না। হাজার হাজার ইসরাইলি যেন ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছেন।
তেল আবিব, জেরুজালেমসহ সারাদেশে লাখ লাখ ইসরাইলি রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন। তারা আগাম নির্বাচন দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পারফর্মেন্সে তারা ধৈর্য্য হারিয়েছেন। এর মধ্যে আছেন অনেক সরকারি কর্মকর্তা।
আল-জাজিরার বিশেষ রিপোর্টে এসব কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞ ও সমালোচকরা। বুধবারও নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে বিপুল পরিমাণ বিক্ষোভকারীর সমাবেশ দেখা গেছে। কিন্তু তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা বড় রকমের শক্তি ব্যবহার করে।
ইসরাইলি ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট সর্বশেষ একটি জরিপ করেছে। তাতে ইসরাইলিদের ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের প্রতিফলন ঘটেছে। ওই জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫৭ ভাগ ইসরাইলি বলছেন, যুদ্ধ শুরুর পর নেতানিয়াহুর পারফর্মেন্স নেমে এসেছে দুর্বল অথবা অতি দুর্বল অবস্থানে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরাইল ও ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইরাভ জোনসজেইন বলেছেন, জনগণের মধ্যে একটি সেন্টিমেন্ট দেখা দিয়েছে যে, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত নন নেতানিয়াহু। তিনি শুধু নিজের স্বার্থে টিকে থাকার জন্য নিজস্ব রাজনীতি করছেন। জিম্মিদের পরিবারের এবং সাবেক নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তারা চাইছেন সরকারের পরিবর্তন। তারা সবাই একটি নতুন নির্বাচন চান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশির ভাগ মানুষ চাইছেন যে নেতানিয়াহু ক্ষমতা থেকে সরে যাক। তবে খুব কম মানুষই যুদ্ধের ইতি চাইছেন। ৭ই অক্টোবর হামাসের কাসেম ব্রিগেড ইসরাইলে রকেট হামলা চালিয়ে হত্যা করে ১১৩৯ জনকে। জিম্মি করে প্রায় ২৫০ জনকে। এর বেশির ভাগই ইসরাইলের সাধারণ মানুষ।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে লড়াই করেছেন ইসরাইলি সাবেক সেনা কর্মকর্তা নাতান গোরশোনি (৭৪)। তিনি বলেন, আমি হামাসকে ভয়াবহ বলে মনে করি। কিন্তু নেতানিয়াহু যা করতে পারেন তার সর্বোত্তম তিনি করছেন না। ঠিক এই মুহূর্তে আমি চাই যেকোনো মূল্যে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা হোক। তারপর আমরা গাজার সমস্যা সমাধান করতে পারবো।
১৫ই মার্চ যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস একটি প্রস্তাব দেয়। তা হলো ইসরাইলের জেলে আটক থাকা হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে বাকি ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে হবে। গাজা থেকে ইসরাইলি সেনাদের প্রত্যাহার করতে হবে। গাজার দক্ষিণে বাস্তুচ্যুত উত্তরাঞ্চলের সাধারণ মানুষকে ফিরতে দিতে হবে এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে হবে। কিন্তু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন নেতানিয়াহু। তিনি এ প্রস্তাবকে অবাস্তব বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু জোনসজেইন বিশ্বাস করেন, আসলে নেতানিয়াহু একটি যুদ্ধবিরতি এড়াতে চাইছেন, যাতে তিনি যতদিন যুদ্ধ চলে ততদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন। যুদ্ধে টিকে থাকার এটাই হলো নেতানিয়াহুর মৌলিক ইস্যু। তিনি আরও বলেন, যখনই যুদ্ধবিরতি হবে, তখনই এ বিষয়ে আরও ক্ষেত্র তৈরি হবে। তদন্তের দিকে দৃষ্টি দেয়া হবে এবং নির্বাচন দাবি করা হবে। উগ্র ডানপন্থি জোট, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী বেজালের স্মোট্রিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী বেন গাভিরের পক্ষ থেকেও বাধার মুখে পড়তে পারেন নেতানিয়াহু। যদি হামাসের সঙ্গে চুক্তি করাকে বেনিয়ামিন সরকার প্রতিকূল মনে করে, তাহলে তারা দু’জনেই নেতানিয়াহুর জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এমন হলে নেতানিয়াহু নতুন আরেক সঙ্কটে পড়বেন। স্মোট্রিচ এমনকি বলেছেন, জিম্মি উদ্ধার অতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু তার এই মন্তব্যে জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদের আছে আরও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। গাজায় যুদ্ধে নিহত হয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান গাডি আইজেনকোটের ছেলে। তিনি জিম্মি ও তাদের পরিবারের পক্ষে পরামর্শ দিয়েছেন যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদে। তিনি মনে করেন, হামাসের সিনিয়র নেতাদেরকে হত্যা করার চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্ত করায়। কিন্তু তার এই মত সীমিত। কারণ তিনি বা আরেক সাবেক সেনাপ্রধান বেনি গান্টজ, কেউই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। তারা মন্ত্রিপরিষদ থেকে বেরিয়ে গেলেও একটি নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে পারবেন না। তারা যদি একবার নেতানিয়াহুর জোট থেকে বেরিয়ে যান, শুধু তাহলেই তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব। এমন হলে তিন মাসের মধ্যে ইসরাইলে নতুন নির্বাচন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। কারণ নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে।
এমন চাপ সত্ত্বেও সম্প্রতি মিশরের রাজধানী কায়রোতে হামাস নেতাদের সঙ্গে সমঝোতায় প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন নেতানিয়াহু। ফলে ফিলিস্তিনিদেরকে এখন গাজার উত্তরে ফিরতে দেয়ার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত ইসরাইলি নেতারা। তা সত্ত্বেও ইসরাইলি ভাষ্যকার এবং ৯৭২ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ওরিন জিভ বলেছেন, নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই চাইবেন।