অন্যান্য

‘জুলাই বিপ্লবের’ তথ্য সংরক্ষণ করেছেন স্বেচ্ছাসেবকদের দুই ওয়েবসাইট

ছবি: সংগৃহীত

 আন্দোলনের ইতিহাস যেন কোনোভাবে লুকানো বা বিকৃত না হয়, সেজন্যই ‘শহীদ ডট ইনফো’ সাইট তৈরি করা। এখানে আন্দোলনে নিহত ও আহতদের সংখ্যা দেখা যাবে। বললেন থাইল্যান্ডের একটি কোম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জসীমউদ্দিন। 

এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলা-সংঘর্ষে হতাহতদের সংখ্যা ও পরিচয় সংরক্ষণে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন জসীম উদ্দিন। নাম দেন ‘শহীদ ডট ইনফো’। 

এ ওয়েবসাইটে এখন পর্যন্ত ৪৯০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে আর আহতদের তালিকায় রয়েছে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ। গ্রেপ্তার ও নিখোঁজের হিসাব দেয়া হয়েছে ১১ হাজারের বেশি। আন্দোলনের মধ্যে অল্প সময়েই ওয়েবসাইটটি অনেকের কাছে পরিচিতি পায়। 

জসীম উদ্দিনের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করা এ তরুণ ‘শহীদ ডট ইনফো’ ওয়েবসাইট খুলেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগেই।

ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলনে হতাহতদের পরিসংখ্যানের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগে কোনো ডেটাবেইজ বা ওয়েবসাইট তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল মান্নান মাসুদ। আন্দোলনে ‘শহীদ ডট ইনফো’ থেকেই তথ্যগত সহায়তা নেয়ার কথা বলেছেন তিনি।

সমন্বয়ক আব্দুল মান্নান মাসুদ বলেন, “আমাদের এখনও কোনো ওয়েবসাইট করা হয়নি, তবে পরিকল্পনা আছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখনই ওয়েবসাইট চালু করতে পারছি না। আপাতত তথ্য আমাদের কাছে রাখছি, পরে ডেটাবেইজ করা হবে।” 

সরকার, আন্দোলনকারী ও সংবাদমাধ্যমের হিসাবে হতাহতের সংখ্যা বিভিন্নরকম। অল্প কিছুদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন মৃত্যু সংখ্যা হাজারের বেশি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এই সংখ্যা ৬৫০ বলা হয়েছে। আবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের হিসাবে ৬০০-৭০০এর মধ্যে কয়েক রকম সংখ্যা এসেছে। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন পরে সরকারপতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নিলে ৪ আগস্ট সংঘাত, সংঘর্ষ আর গুলিতে এক দিনেই ১০০ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে সংবাদমাধ্যমে। পরদিন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির দিন দেশজুড়ে আরও শতাধিক মানুষের প্রাণহানির খবর আসে। তুমুল গণআন্দোলনের ওই দিনেই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।

গোটা আন্দোলনে হতাহতের হিসাব রাখতে গিয়ে সরকারি রোষানলেও পড়ার কথা জানান ‘শহীদ ডট ইনফো’র জসীমউদ্দিন।

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের নয় দফার আন্দোলনের সময় সাইটটি বাংলাদেশে ব্যান করা হয়েছিল। সরকারপতনের পর সেটি তুলে নেয়া হয়।”

জসীম উদ্দিন জানান, আন্দোলনের হতাহতের তথ্য সংরক্ষণ করায় আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। তার ভাষ্য মতে, “২৪ থেকে ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রায় ১০ জন আমার লিংকডইন প্রোফাইল ভিজিট করে, যাদের অনেকেই সাইবার ক্রাইম সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। আমার সাইটে বারবার রিপোর্ট করা হয়েছে। আতঙ্কে নিজের সব যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও ‘প্রাইভেট’ করতে হয়েছিল।”

হতাহতের তথ্য যাচাই কীভাবে?

জসীম উদ্দিন থাইল্যান্ডে অবস্থান করলেও দেশে তার ২৩ জনের একটি দল রয়েছে। তারা আহত ও নিহতদের তথ্য, ছবি ও অন্যান্য বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে যাচাইয়ের কাজটি করেন।

জসীম উদ্দিন বলেন, “তথ্য প্রকাশের আগে সেই ব্যক্তি মারা গেছেন নাকি আহত হয়েছেন তা যাচাই করা হয়। যেন কোনো ভুল তথ্য প্রকাশ না পায়।”

যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শুরুতে ফেইসবুকে হাজার হাজার পোস্টের মধ্য থেকে নিহত বা আহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারের করা পোস্টগুলোই বিবেচনা করা হয়েছে। তবে এখন প্রায় ১০ জনের আইটি ও ভেরিফিকেশন টিম দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের কাছে আসা পোস্টগুলো ভেরিফাই করার কাজ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্য পত্রিকার তথ্যগুলোও নেয়া হয়েছে।

“পরবর্তীতে একটি গুগল ফর্মে ডেটা সংগ্রহ করা হয়। তথ্যগুলো যেন কোনোভাবে ভুল না হয়, তাই দুই স্তরে হয় ভেরিফিকেশন।” অন্য সদস্যরা তথ্য যাচাই করলেও তথ্য প্রকাশের কাজটি করে থাকেন জসীম নিজেই।

হতাহতের তালিকা ছাড়াও ওয়েবসাইটে ‘ভার্চুয়াল মিউজিয়াম’ নামে একটি ক্যাটাগরি যুক্ত করা হবে বলে জানান জসীম। সেখানে পুরো আন্দোলনকে ফুটিয়ে তোলা হবে। আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, গ্রাফিতি, ছবি সংরক্ষণ করা হবে।

এছাড়া ওয়েবসাইটে নিহত ও আহত হওয়া ব্যক্তিদের প্রোফাইল ব্যবহারের সুযোগ পাবেন পরিবারের সদস্য বা স্বজনরা। তারিখ ও ইভেন্ট ধরে ঘটনাপ্রবাহ লিখে রাখার কাজও চলছে বলে জানান তিনি।

হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা

আন্দোলনে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরির কথা জানিয়েছেন জসীম উদ্দিন। তাদের সহায়তায় বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গেও কাজ করার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

“ইতোমধ্যে শহীদ ডট ইনফোর উদ্যোগে বেশকিছু পরিবারকে সাহায্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া রক্ত সংগ্রহ করে দেয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়ার মত চিকিৎসা সহায়তা করা হয়েছে অনেককে। তবে সাহায্যের জন্য পাবলিক ফান্ডের সাহায্য নেয়া হবে না।”

‘চিনে রাখুন’

আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ও হতাহতদের তথ্য সংরক্ষণে সমন্বয়কদের কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকলেও ‘শহীদ ডট ইনফো’ এর ব্যাপারে জানেন অনেকেই।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে পড়াশুনা শেষ করা এক তরুণ তৈরি করেছেন ‘চিনে রাখুন’ নামে আরেক ওয়েবসাইট।

জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে আহত, নিহতদের সংখ্যা এবং আন্দোলনে আক্রমণকারীদের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে এ ওয়েবসাইটে। আন্দোলনচলাকালে পরোক্ষভাবে আক্রমণ করেছে এমন ১৩ জনের নাম ও পরিচয় এ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

‘চিনে রাখুন’ তৈরির ভাবনা শাবাব জুনায়েদের হলেও সাইটটি তৈরি করেছেন তার বন্ধু নুর মোহাম্মদ মামুন। তাদের পুরো টিম থাকেন ঢাকাতেই। সাইটটিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা-আক্রমণকারীদের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও আপলোড করা হয়।

শাবাব জুনায়েদ বলেন, “আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চলাকালে ‘চিনে রাখুন’ ওয়েবসাইট তৈরির কথা ভাবি, যেন ‘অপরাধীদের’ সবাই চিনতে পারেন এবং তাদের আইনের আওতায় আনা সহজ হয়। এ ছাড়া অপরাধের তথ্য-প্রমাণ যেন সংরক্ষণ করা যায়।”

তিনি জানান, গত ৪ আগস্ট চালু হওয়া এ সাইটে তথ্য যাচাইয়ের কাজ করেন তিনজন। আরও সাতজন তথ্য সংগ্রহ, সাবমিশনসহ অন্যান্য কাজ করছেন। তবে ‘আক্রমণকারীর’ পরিচয় বা ছবি/ভিডিও প্রকাশের আগে শেষ ধাপের যাচাইয়ের কাজটি করেন শাবাব নিজে। তথ্য যাচাই করা না গেলে সাবমিশন সরিয়ে ফেলা হয়। 

শাবাব বলেন, “একটি কিইস ভেরিফাই করতে ৩/৪ দিন বা আরও বেশি সময় দরকার পড়ে। ছবি, ভিডিও পাওয়ার পরে সেই ব্যক্তির সোশাল অ্যাকাউন্ট যাচাই-বাছাই করে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।

“রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গুগলে সার্চসহ সেই ব্যক্তি সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে নাম, পরিচয় ও দলের সম্পৃক্ততার তথ্য যাচাই করা হয়। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ হলে তার নাম, থানা, পেশাগত পদবি সার্চ করে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। স্পষ্টভাবে কোনো পরিচয় বা তথ্য নিশ্চিত না হলে তা সাইটে প্রকাশ করা হয় না।”

তিনি বলেন, “আরও নির্ভুল তথ্যের জন্য আমাদের মাঠ পর্যায়ের কাজের পরিকল্পনা রয়েছে। ওয়েবসাইটটিতে আন্দোলনচলাকালে পরোক্ষভাবে আক্রমণ করেছে এবং পরবর্তীতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, তাদের পরিচয় প্রকাশ করেও একটি অংশ চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

গেলো বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাইটটিতে বিস্তারিত পরিচয়, ছবি, ভিডিওসহ ৩০ জন ‘আক্রমণকারীর’ পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে।

শাবাব বলেন, “এটা পাবলিক ও ওপেন সাইট। সারা দেশ থেকে এখানে নিহত ও আহতদের স্বজন, পরিচিত ও সাধারণ মানুষ ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য পাঠায়। গণমাধ্যমের তথ্যও নেয়া হয়। সেখান থেকে তথ্য দুই-তিন স্তরে ভেরিফিকেশনের পরে পাবলিশ করা হয়।”

‘চিনে রাখুন’ ওয়েবসাইটে আন্দোলনে ‘অফিসিয়াল ডেথ’ দেখানো হয়েছে ৪৩৯ জনের বেশি। আর আনুমানিক মৃত্যু দেখানো হয়েছে ১১৫০ জনের বেশি। এ ছাড়া ২১ হাজারের বেশি আহত দেখানো হয়েছে।

‘চিনে রাখুন’ ও ‘শহীদ ডট ইনফো’ সাইটে আন্দোলনের এসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ‘চিনে রাখুন’ সাইটের বিষয়টি জানেন না আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল মান্নান মাসুদ।

শাবাব জুনায়েদও জানান, আন্দোলনের কোনো সমন্বয়কের সঙ্গে তিনি ওয়েবসাইটের ব্যাপারে যোগাযোগ করেননি। তবে ওয়েবসাইটের বাকি কাজ শেষ করে সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা আছে তার।

এদিকে হতাহতদের পরিচয়সহ একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে।


কেএস// 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন