আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার
শেখ হাসিনাদের ফাঁসি চায় না এইচআরডব্লিউ, আইন সংশোধনের আহবান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের মৃত্যুদণ্ড চায় না আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বরং শেখ হাসিনাসহ অন্যদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের আহবান জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক এই সংস্থাটি।
গেলো ২১ অক্টোবর বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে লেখা এক চিঠিতে মানবাধিকার সংস্থাটি আরও জানায়,বিচার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়ার আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত।
এইচআরডব্লিউ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের বিদ্রোহের সময় যে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তার বিচারের উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের বিরোধিতা করে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ চলাকালীন গণহত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের (প্রকৃত সংখ্যা ৪৬ জন) বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের সময় ‘গণহত্যা, হত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর (স্বাস্থ্য উপদেষ্টা) মতে, বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যধিক এবং নির্বিচারে গোলাবারুদ ব্যবহার এবং তার দলের সমর্থকদের সহিংস হামলার কারণে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়েছেন। পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া হাসিনাকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই ও আগস্টের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সময় ব্যাপক নিপীড়নের জন্য শেখ হাসিনাসহ অন্যদের ভূমিকা তদন্ত করা উচিৎ। তারা দায়ী প্রমাণ হলে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করা শুধুমাত্র জবাবদিহিতা প্রক্র্রিয়াকে শক্তিশালী করবে এবং ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের প্রকৃত বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একমাত্র উপায়।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে লেখা এক চিঠিতে এইচআরডব্লিউ বলেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ন্যায়বিচারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানায়। বিচারিক প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং মূল স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সংশোধনী প্রস্তাব করার আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে আমরা প্রশংসা করি।
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে কিছু সংশোধনীর আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া।
মৃত্যুদণ্ডের ওপর একটি স্থগিতাদেশ গ্রহণ করুন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার পদক্ষেপ নিন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সব পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে। এটি সহজাত নিষ্ঠুর, অস্বাভাবিক শাস্তি এবং মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাই এই শাস্তি অপসারণের সুপারিশ করছে এইচআরডব্লিউ।
আইনের ২১ (২) ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করা হয়। বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, রুয়ান্ডার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গ টানা হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার লক্ষ্যে ফাঁসি কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়ার জন্য গৃহীত একটি প্রস্তাবের কথা স্মরণ করে দেওয়া হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে হাসিনা সরকারের অধীনে ট্রাইব্যুনালটি গঠিত হয়। এতে সুষ্ঠু বিচারের মান লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সাক্ষ্য সংগ্রহের ব্যর্থতা, প্রসিকিউটরদের সাথে যোগসাজশসহ বিচারকদের স্বাধীনতার অভাব, অভিযুক্তের আত্মীয়দের জোর করে গুম করা এবং মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের সাথে দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করার অনুরোধ জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মৃত্যুদণ্ডের বিধানে স্থগিতাদেশ জারি করলে এবং অভিযুক্তরা যাতে আন্তর্জাতিক মান, মানবিক মান অনুযায়ী ন্যায় বিচারের মুখোমুখি হবে তা নিশ্চিত হলে ভারত এবং অন্যান্য সরকারের উচিত বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানানো।
বিচার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এমআর//