২৮টি উপায়ে দুর্নীতি হয় আওয়ামী লীগ আমলে
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে উন্নয়নের বয়ান শুধু দেশেই নয় বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে, একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন পদ্ধতিতে দুর্নীতি করে দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছে।
উন্নয়নের বয়ানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮টি উপায়ে দুর্নীতি করার তথ্য জেনেছে কমিটি।
যার মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতিবছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক ও গভীর ছিল। এই প্রতিবেদন গতকাল রোববার (১ ডিসেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কমিটি বলেছে, মূলত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে-সব পদ্ধতিতে বাংলাদেশে দুর্নীতি হয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি। তারমধ্যে
১. ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, প্রতারণাপূর্ণ ব্যাংকঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে ঋণের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে আওয়ামীলীগ আমলে।
২. শ্বেতপত্র কমিটি বলছে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে জোর করে ব্যাংকের মালিকানা অধিগ্রহণ বা দখল করা হয়েছে।
৩. বেআইনিভাবে যে অর্থ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থের পরিমাণ ছিল বিপুল।
৪. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লাভজনক হবে না, এমন প্রকল্পে সম্পদের অপচয় করা হয়েছে। সময়মতো এসব প্রকল্প শেষ করা হয়নি। বিপুল অর্থ খরচের কারণে তা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
৫. টাকা চুরির উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
৬. তহবিলের অর্থ নিজেদের পকেটে ঢুকাতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের পর কৃত্রিমভাবে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
৭. নিজের এবং নিজেদের লোকদের সুবিধা বিবেচনা করে সরকারি কেনাকাটা করা হয়েছে। যোগ্য সরবরাহকারীদের এ প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখা হয়েছে।
৮. প্রকল্প নিতে দুর্বলভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। একারনে সম্পদের অপচয় হয়েছে। প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা হয়নি, বেড়েছে খরচ।
৯. প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ পাওয়ার মাপকাঠি ছিল রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ। এ ক্ষেত্রে মেধা বিচার করা হতো না।
১০. ভূমি ও সম্পদ জব্দ কিংবা অধিগ্রহণ করা হয়েছে বেআইনি পন্থায়।
১১. যে-সব ভূমিমালিকের শক্ত রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না, তাঁদেরকে অসম চুক্তিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার করা হয়েছে।
১২. রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারদের যে-সব সরকারি কাজ দেওয়া হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তার মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই এসব কাজ দেওয়া হয়েছে ।
১৩. ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য যানবাহন, ভ্রমণ বাজেট এবং প্রকল্পের অন্যান্য সম্পদের অপব্যবহার করা হয়েছে।
১৪. কাজের প্রক্রিয়া জোরদার করা কিংবা বিশেষ সুবিধা নিতে নিয়মিত ঘুষের লেনদেন হতো।
১৫. নেতাদের রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে পূরণে উন্নয়নকাজের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে।
১৬. অভিজাতদের কর অব্যাহতি দিয়ে কর নীতি অসংগতভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধা দিয়েছে।
১৭. সরবরাহ ব্যবস্থাকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা পণ্যমূল্য অন্যায্যভাবে বাড়িয়েছে এবং বাজারে অদক্ষতা সৃষ্টি করেছে।
১৮. নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর কাছে নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ফাঁস করে দিয়ে তাদেরকে আর্থিকভাবে লাভবান করানো হতো।
১৯. সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি ব্যক্তিরা আঁতাত করে দুর্নীতি করতো।
২০. ঘুষ আদায় কিংবা অন্যায্য লেনদেনের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতো।
২১. বাজার পরিস্থিতি এমনভাবে পরিচালনা করা হতো, যাতে বিশেষ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়।
২২. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আগেই জানিয়ে দেওয়া হতো, ফলে বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা পেত।
২৩. অংশীজনদের বিভ্রান্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রাখা হতো।
২৪. ঘুষ আদায়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করা হতো।
২৫. পদোন্নতি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে ঘুষ নেওয়া হতো।
২৬. কোনো বিষয়ে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কমিশনের ভাগ চাইতেন।
২৭. রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা সুবিধা বিবেচনা করে সম্পদের ব্যবহার করা হতো।
২৮.: স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আইন ও নীতি প্রণয়ন করা হতো।
শ্বেতপত্র কমিটির সদস্যরা দেখতে পেয়েছেন যে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত। এরপর রয়েছে ভৌত অবকাঠামো খাত এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) হলো আরেকটি খাত, যা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ওয়াই/এ/এস