জাতীয়

আবারো পিছিয়ে যাচ্ছে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন

বিদ্যুৎ উৎপাদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দীর্ঘ এক দশক ধরে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণু সংস্থা রোসাটমের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শেষে বর্তমানে চলছে পরমাণু জ্বালানি ইউরেনিয়াম লোডের প্রস্তুতি। তবে, চূড়ান্ত এই পর্যায়ে একের পর এক নেতিবাচক খবরে প্রকল্পটি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে

রূপপুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রকল্পের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক পারমাণু সংস্থা আইএইএর প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা পরিকল্পিতভাবে বিকৃত করে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। তারা আরও বলেছে, আইএইএ এর অনুমোদন ছাড়া এবং নিরপত্তার শর্ত পূরণ না করে কোনোভাবেই উৎপাদন শুরু করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক পারমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট পারমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করে না। সংস্থাটি মিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর তা সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করে। আইএইএ এর আইনগত লক্ষ্য হলো পারমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ত্বরান্বিত করা এবং সামরিক ব্যবহারের প্রতিরোধ নিশ্চিত করা। সংস্থাটি সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ, পিয়ার রিভিউ (Peer Review) সেবা ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রদত্ত সুপারিশ দেয়, যা জাতীয় পর্যায়ে পারমাণু অবকাঠামো ও নিরাপত্তা প্রক্রিয়া উন্নত করতে সহায়ক।

প্রকল্প সূত্র জানায়, আইএইএর একটি বিশেষজ্ঞ দল গত ১০-২৭ আগস্ট রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রি-ওসার্ট মিশন পরিচালনা করেছে। এরপর সংস্থাটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রেসনোট প্রকাশ করে সফর ও পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে সতর্কবার্তা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে রূপপুর প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে আইএইএ। প্রতিবেদনের সুপারিশ ও শর্ত পূরণের পরই পরমাণু চুল্লীতে জ্বালানি লোডিং করা সম্ভব হবে। এর আগে কেন্দ্র চালু করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিটে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে, গোপন প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে নিরপত্তা নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর চেষ্টা এবং ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাউল্লেখ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানো হয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তা বলছেন, এটি পরিকল্পিত অপপ্রচার এবং ভুল তথ্যের মাধ্যমে রূপপুরকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা।

সম্প্রতি আইএইএর প্রি-ওসার্ট মিশন বাংলাদেশের কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে, যেখানে প্রকল্পের কিছু অসংগতি, সুপারিশ ও পরামর্শ উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের মতামত পাওয়ার তিন মাস পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে, এবং এরপর আন্তর্জাতিক সংস্থা চূড়ান্ত ওসার্ট মিশন পাঠাবে। সব কিছু ঠিক থাকলে কেন্দ্র তখন পারমাণবিক জ্বালানি লোডের জন্য প্রস্তুত হবে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, পুরো প্রক্রিয়া চলতি বছরে শেষ করা সম্ভব নয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আবারো পিছিয়ে যাচ্ছে।

পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জরুরি পরীক্ষা দুই ভাগে হয়। প্রথমটি নন-নিউক্লিয়ার টেস্ট, যা ফুয়েল লোডিংয়ের আগে সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয়টি নিউক্লিয়ার টেস্ট, যা ফুয়েল লোডিংয়ের পর করা হয়। রূপপুরে প্রায় ১,৭০০টি নন-নিউক্লিয়ার পরীক্ষা প্রয়োজন, যেগুলোর মধ্যে ৭৫০টির মতো হয়েছে। প্রকল্পে কারিগরি সমাধান বা বিকল্প উপায়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৩,০০০টি টেকনিক্যাল সলিউশনদেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

 হাইড্রোস্ট্যাটিক টেস্টের জন্য কেন্দ্রের সার্কিট ২৪.৫ মেগাপ্যাসকেল চাপে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার আগে সব যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে স্থাপন বাধ্যতামূলক। রূপপুরে নিরাপত্তা ভালভ না বসিয়ে পরীক্ষা করার অভিযোগও এসেছে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রতিরোধক তার ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ আছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ধার নেওয়া উপকরণ, অস্থায়ী বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার, মেকানিক্যাল ড্রাফট কুলিং টাওয়ারে অননুমোদিত উপকরণের ব্যবহার-এসব বিষয়ে আইএইএ আপত্তি জানিয়েছে।

প্রকল্পের জরুরি অবস্থার জন্য ১০.৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ডিজেল জেনারেটর স্থাপনের কথা থাকলেও মূল ডিজাইনের বাইরে গিয়ে অস্থায়ীভাবে বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, ফ্যান, পাম্প, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতির মান ও স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব ত্রুটি সংশোধন করে প্রাথমিক জ্বালানি লোডিংয়ের আগে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

রূপপুর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, আইএইএর সুপারিশ ও সতর্ক নির্দেশনা স্বাভাবিক এবং তা আন্তর্জাতিক মান অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এনপিসিবিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান বলেন, রূপপুর কেন্দ্র শতভাগ নিরাপদ করার জন্য আইএইএর পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে এবং কমিশনের অনুমোদন পেলে জ্বালানি লোড করা হবে। প্রি-ওসার্ট মিশনের পর্যবেক্ষণ নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই। বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বাকি পরীক্ষা দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। অন্য দেশের প্রি-ওসার্ট মিশনের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনেক ভালো।

প্রকল্প কর্মকর্তারা পুনর্ব্যক্ত করেছেন, কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র পরিচালনা করা হবে না। তবে এটি নিশ্চিত করে যে, রূপপুরে বিদ্যুৎ উৎপাদন আবারও পিছিয়ে যাচ্ছে।

 

আই/এ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন