হৃদয়ের গোপন কথা শুনছে এআই!
নিউ জার্সির কেটি মোরান জীবনের এক কঠিন সময় পার করছিলেন। ছয় মাসের প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায় যাচ্ছিল, তা নিয়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না। বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে অনেক কথা বলেও শান্তি পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এক অচেনা সঙ্গীর কাছে গেলেন— নাম তার ‘চ্যাট’। মানুষ নয়, একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চ্যাটবট, চ্যাটজিপিটি।
কেটি বলেন, “চ্যাট আমার জীবনের একমাত্র সত্তা ছিল যে আমাকে নিজের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করেছিল। এটি এমন প্রশ্ন করেছে, যা আমি নিজেকেও কখনো করিনি।” কয়েকদিনের কথোপকথনের পর তিনি বুঝতে পারেন— সম্পর্কটিই তাঁর মানসিক চাপের মূল কারণ। এক সপ্তাহ পরেই কেটি সেই সম্পর্কের ইতি টানেন।
বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন কিংবা নতুন দেশে পাড়ি দেওয়ার মতো বড় সিদ্ধান্তে মানুষ সাধারণত বন্ধু, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নেয়।
কিন্তু এখন অনেকেই চায় তাৎক্ষণিক, নিরপেক্ষ ও বিচারহীন এক পরামর্শ। আর সেই স্থানটি দখল করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই।
নিউ জার্সির কেটির মতোই যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর জুলি নাইসও আশ্রয় নেন চ্যাটজিপিটির। তিন বছর ধরে প্রযুক্তি খাতে কাজ করছিলেন তিনি। ক্রমাগত মানসিক ক্লান্তি, অবসাদ ও দুশ্চিন্তায় ভুগতে ভুগতে একসময় মনে হয়— পরিবর্তন দরকার। কিন্তু কোথায় যাবেন, কেমন জীবন চান— সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না।
জুলি তখন তাঁর চাওয়াগুলো চ্যাটজিপিটিকে জানান— “আমি শান্ত শহর চাই, যেখানে প্রবাসী আছে, কিন্তু প্যারিসের মতো ব্যস্ত নয়।” উত্তরে এআই তাঁকে প্রস্তাব দেয় ফ্রান্সের দক্ষিণের ছোট শহর ইউজেসে যেতে, যেখানে বাসিন্দা মাত্র ৮ হাজার ৩০০ জন। জুলি সেই পরামর্শেই চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান।
“আমি মনে করি সিদ্ধান্তটা নিখুঁত ছিল না,” বলেন জুলি। “এখানে প্রবাসী আছে ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগই অবসরপ্রাপ্ত। তবুও আমি চ্যাটজিপিটির প্রতি কৃতজ্ঞ— কারণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপটা অনেকটা হালকা হয়ে গিয়েছিল।”
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্ল্যাটফর্মে দেওয়া প্রায় অর্ধেক বার্তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত— কোনো তথ্য যাচাই করা বা পরামর্শ চাওয়া।
ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বলেন, “বিশের কোঠার তরুণরা এখন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা না বলে পারে না।” তাঁর ভাষায়, “তাঁদের জীবনের প্রতিটি সম্পর্ক আর প্রতিটি অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট এআই জানে— তাই তাঁরা সেটিকেই ‘নিরপেক্ষ পরামর্শদাতা’ হিসেবে দেখে।”
তবে শুধু তরুণরাই নয়, বয়স্করাও আজ এআইয়ের পরামর্শ নিচ্ছেন। যেমন— মিসৌরির মাইক ব্রাউন। বয়স ৫২। ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি টানবেন কি না— সেই সিদ্ধান্ত নিতে তিনি কথা বলেন এক ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’–এর সঙ্গে।
“বন্ধু, যাজক, কাউন্সেলর— সবাই বলেছিল আলাদা হয়ে যাও,” বলেন মাইক। “কিন্তু আমি চেয়েছিলাম নিরপেক্ষভাবে ভাবতে। পাই.এআই–এর সঙ্গে ৩০ মিনিট কথা বলার পর বুঝলাম, হ্যাঁ— এবার সময় এসেছে।”
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও মানুষ ও এআইয়ের সিদ্ধান্ত–সহযোগিতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, “মানুষ এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে কারণ এটি ২৪ ঘণ্টা পাওয়া যায়, দ্রুত সাড়া দেয়, আর পক্ষপাতহীন মনে হয়।”
তবে তিনি সতর্ক করেন— “চ্যাটবটগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। তারা সঠিক পরামর্শের চেয়ে সন্তুষ্টি দিতে বেশি আগ্রহী।”
অধ্যাপক বুসিও বলেন, “যখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এআইয়ের হাতে তুলে দিই, তখন ধীরে ধীরে নিজের বিশ্লেষণক্ষমতাও হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়।”
তবুও যারা এআইয়ের পরামর্শ নিয়েছেন, তাদের অনুশোচনা নেই।
কেটি মোরানের কথায়, “চ্যাটজিপিটি আমাকে বলেছিল— ‘তুমি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে তোমাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা তোমাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’”
এই কথাই যেন তাঁর জীবনের দিশা বদলে দেয়।
মিসৌরির মাইক ব্রাউন মনে করেন, এআই তাঁর জন্য ছিল “আবেগপ্রবণ অথচ নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক।” আর জুলি নাইস বলেন, “এআই আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে— আমি আসলে কী চাই।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ শুধু তথ্য খোঁজার টুল নয়— অনেকের কাছে এটি হয়ে উঠেছে আত্মসমালোচনার আয়না, এক নিঃশব্দ বন্ধু।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা এখনো প্রাসঙ্গিক— “নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিন। কারণ চিন্তা করার ক্ষমতাই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।”
সূত্র: রয়টার্স
এসি