এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কী এবং সৌদি আরব কেন এটি চায়?
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন এবং সেখানে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ২০১৮ সালের পর এটি তার প্রথম সফর, যা দুই দেশের ঘনিষ্ঠ ও শক্তিশালী সম্পর্কের প্রতিফলন।
সম্প্রতি এই সম্পর্কের আরও একটি প্রমাণ এসেছে—সৌদি আরবের কাছে সর্বাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির পরিকল্পনা। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব এই যুদ্ধবিমানের জন্য আবেদন করলেও পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসনগুলো অনুমোদন দেয়নি, যার পেছনে আংশিক কারণ হিসেবে ইসরায়েলের আপত্তি ছিল। এবার ট্রাম্প প্রশাসন সেই অবস্থান পরিবর্তন করেছে।
এফ-৩৫ কী?
এফ-৩৫ বা এফ-৩৫ লাইটনিং-২ হলো মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিনের তৈরি স্টেলথ স্ট্রাইক ফাইটার জেট। এটি “বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমান” হিসেবে পরিচিত। স্টেলথ প্রযুক্তির কারণে এটি সহজে রাডারে ধরা পড়ে না এবং শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধবিমানকে আঘাত হেনে দ্রুত আকাশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
এফ-৩৫ তৈরির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার, যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য। তারা হয় যুদ্ধবিমানের কিছু নির্দিষ্ট উপাদান তৈরি করে অথবা তাদের নিজস্ব সরকার ব্যবহার করবে এমন বিমান তৈরির সুবিধা রয়েছে।
কী কী ধরণের হয় এফ-৩৫
এফ-৩৫এ হল এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে প্রচলিত বৈকল্পিক, যা সবচেয়ে বেশি দেশ ব্যবহার করে। এটি সাধারণ রানওয়েতে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে। এর অস্ত্র ও জ্বালানি ট্যাংক সম্পূর্ণভাবে জেটের বডির ভেতরে থাকে, যাতে রাডার এড়ানোর গোপন (stealth) সক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকে।
এফ-৩৫আই “আদির (Adir)” হলো ইসরায়েলের নিজস্বভাবে কাস্টমাইজ করা এফ-৩৫এ যুদ্ধবিমান। এতে ইসরায়েলি উন্নত জ্যামিং ও ডিকয় সিস্টেম যুক্ত করা হয়েছে, যা এর স্টেলথ ক্ষমতা আরও বাড়ায়। দীর্ঘ দূরত্বে জ্বালানি পুনরায় ভরার প্রয়োজন কমাতে এতে বহিরাগত জ্বালানি ট্যাঙ্ক সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া, স্থানীয় ইসরায়েলি অস্ত্র সংযোজনের সুযোগ তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে জেটটির মূল অপারেটিং সিস্টেম পরিবর্তনের অনুমতি দিয়েছে।
এফ-৩৫বি ব্যবহার করে ইতালি, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। হেলিকপ্টারের মতো উল্লম্বভাবে অবতরণ (Vertical Landing) করতে পারে এবং খুব অল্প দূরত্বে উড্ডয়ন (Short Takeoff) করতে সক্ষম। ফলে ছোট আকারের বিমানঘাঁটি বা হেলিপ্যাড-জাতীয় স্থান থেকেও এটি পরিচালনা করা যায়। তবে এটি এফ-৩৫এ-এর তুলনায় এটি সামান্য ছোট হলেও বেশি ভারী, এবং এর জ্বালানি ও অস্ত্র বহনের সক্ষমতাও কিছুটা কম।
এফ-৩৫সি হলো যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জন্য তৈরি একটি সুপারসনিক যুদ্ধবিমান, যা দীর্ঘ দূরত্বে স্টিলথ অপারেশনের জন্য বিশেষভাবে নকশা করা হয়েছে। এটি বিমানবাহী রণতরীতে ব্যবহারের জন্য তৈরি।
কেন এই ফাইটারগুলি বিশেষ?
এফ-৩৫ নির্মাতা লকহিড মার্টিন এই যুদ্ধবিমানটিকে "বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধবিমান" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিমানটির খ্যাতির বেশিরভাগই আসে এর স্টিলথ, উন্নত সেন্সর এবং একটি একক প্ল্যাটফর্মে উচ্চ-গতির কম্পিউটিং-এর সমন্বয় থেকে।
এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে শত্রু রাডার সহজে তাকে খুঁজে না পায় (স্টিলথ ক্ষমতা), এবং একই সঙ্গে বিমানটির চারপাশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এর মধ্যে থাকা ৩৬০-ডিগ্রি ক্যামেরা সিস্টেম ও অন্যান্য উন্নত সেন্সর চারদিকের ছবি ও তথ্য রিয়েল-টাইমে সরাসরি পাইলটের হেলমেটে বা স্ক্রিনে দেখায়।
আধুনিক যুদ্ধকৌশলে বড় পরিবর্তন আনছে নতুন প্রজন্মের জেট প্রযুক্তি। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব জেটে বিনিয়োগকারী বাহিনী এখন আর শুধু গতির ওপর নির্ভর করছে না। বরং গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আরও উন্নত কৌশলে—প্রথমেই সম্ভাব্য হুমকি শনাক্ত করা, সেই তথ্য দ্রুত বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে পৌঁছে দেওয়া এবং অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে সমন্বয় করে আক্রমণ পরিচালনা করা।
ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে গতি নয়, তথ্য ও সমন্বয়ই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় শক্তি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কৌশলগত পরিবর্তন সামরিক অভিযানে আরও কার্যকারিতা, নিরাপত্তা এবং নির্ভুলতা নিশ্চিত করবে।
সৌদি আরব কেন এফ-৩৫ চায়?
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব মার্কিন অস্ত্রের অন্যতম বড় ক্রেতা হলেও এফ-৩৫ প্রোগ্রামে যোগ দিতে পারেনি। এটি পরিবর্তন করতে পারলে সৌদি আরব তার বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়ন করতে পারবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে।
ইরানের সঙ্গে বর্তমানে সম্পর্ক ইতিবাচক হলেও, অতীতে রিয়াদ ও তেহরান একাধিকবার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং পরস্পরকে হুমকি হিসেবে দেখেছে। সৌদি আরব এর আগেও ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সংঘাতটি এখনও পুরোপুরি সমাধান হয়নি এবং বর্তমানে পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত থাকলেও, আগামী কয়েক বছরে তা আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র কি সৌদি আরবকে এফ-৩৫ দেবে?
মার্কিন কংগ্রেস চাইলে এই অস্ত্র বিক্রি আটকে দিতে পারে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে তিনি এটি বিক্রির পক্ষে।
২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বহুদিনের উত্তেজনাও তিনি গুরুত্ব দেননি। এছাড়া তিনি দীর্ঘদিনের মার্কিন নীতি—ইসরায়েল যেন সবসময় মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে এগিয়ে থাকে—সেটিও অগ্রাহ্য করেন।
ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, সৌদি আরব ইসরায়েলের মতো একই ধরনের এফ-৩৫ পাবে, যদিও রিয়াদ এখনো আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দেয়নি।