অর্থনীতি

এম এ খালেক: কর্পোরেট জগতে উল্কাগতিতে উত্থান এবং নির্মম পতন

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের কর্পোরেট জগতে একসময়কার দাপুটে উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত এম এ খালেক মারা গেছেন। অর্থ আত্মসাতের মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় গেল ৬ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। পরে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ ডিসেম্বর রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ এক ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তিনি। দেহরক্ষীবেষ্টিত জীবনযাপন, দামি গাড়ি ও বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের স্যুট-জুতায় অভ্যস্ত এই ব্যবসায়ীর রাজধানীর গুলশান ও বারিধারায় ছিল একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি।

তবে সময়ের ব্যবধানে সেই দাপট ও জৌলুশ হারিয়ে গিয়েছিলো। জীবনের শেষ সময়ে তিনি হয়ে পড়েন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ। শেষযাত্রায় স্ত্রী বা সন্তান কেউই তার পাশে ছিলেন না। নিকটাত্মীয় ও পরিবারের সদস্যরা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। একারনে কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তার মরদেহ গ্রহণ করেন ভাগ্নে কবির হোসেন। তবে এম এ খালেককে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। জনসম্মুখের কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নীরবে তার দাফন হয়েছে।

১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ পিরোজপুরে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এম এ খালেক। শিক্ষাজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি ব্যাংক, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  

১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক প্রাইম ব্যাংক পিএলসি গঠনে খালেকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়াও তিনি প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজ, প্রাইম প্রুডেনশিয়াল ফান্ডসহ একাধিক আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ায় সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন

ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে গেটকো লিমিটেড, গেটকো অ্যাগ্রো ভিশন, গেটকো টেলিকমিউনিকেশনস, ম্যাকসনস বাংলাদেশ, এইচআরসি টেকনোলজিস, প্রাইম প্রপার্টি হোল্ডিংস ও পিএফআই প্রোপার্টিজের মতো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ছিলো তার। তিনি বেসরকারি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি খালেক

তার বিরুদ্ধে ১০টি কোম্পানি প্রায় ৭০ বিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলে। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত ও একাধিক কর্পোরেট মামলার কারনে তিনি বাড়ি, গাড়ি ও বেশিরভাগ সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হন। তার অনেক সম্পদ জব্দ করা হয়। অভিযোগ আছে, অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের বড় একটি অংশ তিনি কানাডায় পাচার করেছেন। কানাডায় সেই সম্পদ ভোগ করছেন তার স্ত্রী ও সন্তানরা।

ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রাইম ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আজম জে চৌধুরী খালেকের পথচলা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন "খালেক একজন সংগঠক ছিলেন ।  উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগত পুঁজির অধিকারী ছিলেন নাউদ্যোক্তারা তাকে বিশ্বাস করতেন। এমনকি তহবিলকে কার্যকরী মূলধন হিসেবেও এগিয়ে নিয়ে যেতেন। তিনি ব্যাংকিং, বীমা, অর্থ এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলির নেতৃত্ব দিতেন। দুঃখজনকভাবে, তিনি সেই আস্থার প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হন।"

চৌধুরী আরও বলেন, “প্রায় দশটি প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৭০ বিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে। এসব মামলাগুলোর চাপে পড়ে তিনি কানাডায় স্থায়ী আশ্রয় চেয়েছিলেন।  সেখানে তার পরিবার থাকে। কিন্তু তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এখানে তার প্রায় সমস্ত সম্পদ; বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তিনি তার শেষ বছরগুলো বিচ্ছিন্নভাবে কাটিয়েছেন। জেল থেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, খালেক সেখানেই মারা যান।তার করুণ পরিণতি আমাদেরকে কঠোর শিক্ষা দেয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের জানা গেছে, এম এ খালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রায় ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন টাকা, প্রাইম ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজ থেকে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন টাকা, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ২ বিলিয়ন টাকা, পিএফআই প্রোপার্টিজ থেকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন টাকা এবং প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস থেকে ৫০০ মিলিয়ন টাকা, প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজ থেকে ২০০ মিলিয়ন টাকা এবং পিএফআই ক্যাপিটাল থেকে ১৫০ মিলিয়ন টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে খালেক চেয়ারম্যানসহ গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী পদে ছিলেন। একই সঙ্গে একাধিক ব্যাংক তার মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানিকে প্রায় ৬ বিলিয়ন টাকা ঋণ দিয়েছিলো।  এসব টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। একারনে সামগ্রিক ঋণ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।

তার ব্যবসায়িক সহযোগী ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯৮০এর দশকে খালেক মূলধনের চেয়ে মেধা ও পরিশ্রমকে পুঁজি করে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। কর্পোরেট নথিপত্র প্রস্তুত ও সরকারি অনুমোদন আদায়ে তিনি দক্ষ ছিলেন। শুরুর দিকে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতারণার অভিযোগ ছিলোনা। তবে ২০১০ সালের পর তার আচরণ ও কার্যক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তিনি পরিকল্পিতভাবে একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে কানাডায় পাচার করেন। দেশে বিপুল সম্পত্তি ও বিলাসবহুল যানবাহনের মালিক হন। ২০১৮ সালের দিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার আর্থিক অনিয়ম প্রকাশ হতে থাকে। কানাডায় পালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দেশে ফিরেন। পরে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় দুদক তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। গেল নভেম্বরেও একই প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে আবারো কারাবন্দী করা হয়

কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকার রমনা থানায় দায়ের করা একটি মামলায় এম এ খালেককে আটক রাখা হয়েছিল। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ৬ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৩৬ মিনিটে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে তার মৃত্যু হয়।

 

এসএইচ//

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন