আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

মেক-আপ ও গয়না ছাড়া পুরানো আমলের কাতান শাড়ি পড়ে বিয়ে

মুখে নেই মেক-আপ, হাতে-কানে-গলায় নেই ভারী অলংকার, গায়ে নেই জড়োয়া শাড়ি। দাদীর দেয়া পুরানো আমলের কাতান শাড়ি পরেই বিয়ে সেরেছেন তাসনিম।

নিজের বিয়ে নিয়ে ভাবেনা এমন নারী-পুরুষ সমাজ সংসারে বিরল। শৈশব থেকেই সে ভাবনার শুরু হয় বরং বলা যায়। কল্পনার রাজ্যে কেউ কেউ নিজেকে প্রতীক্ষায় থাকা সেই রাজকন্যা হিসেবে কল্পনা করে যাকে শ্বেতশুভ্র ঘোড়সওয়ার রাজপুত্র এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। হাজার হাজার বছরের এই রূপকথা বাস্তবে রূপ না দিতে পারলেও নিজের বিয়েকে স্বাপ্নিক করে তুলতে কেউই কার্পণ্য করতে চান না আর্থিক সামর্থ্য ভেদে। আধুনিক রূপকথার মিনি ভার্সনের দেখা মিলবে কম্যুনিটি সেন্টারগুলোর কোন বিয়ে অনুষ্ঠানে গেলেই। সেখানে অত্যাধুনিক সব সাজ সরঞ্জামে আচ্ছাদিত হয়ে কনে অপেক্ষা করে সুসজ্জিত বরের জন্য। কনেকে দেখে বেশিরভাগ সময়ই চেনার উপায় থাকেনা। কেননা কনের পূর্বের আসল চেহারার সাথে বিবাহ আসরের কনে সাজে সজ্জিত চেহারার মিল যে দূরতম! বিউটি পার্লারে সপ্তাহ ধরে ছোটাছুটি, বিয়ের দিন সকাল থেকে ঘন্টাব্যাপী পরিচর্যা আর কয়েকজন পার্লার শিল্পীর পরিশ্রমের পরেই মেলে প্রত্যাশিত রূপান্তর।

উভয়পক্ষের যথাসর্বস্ব জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বিবাহ অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের সাজ সজ্জাও সাধারণ নয়। ভারী মেক আপ ও দামী পোষাকে সুসজ্জিত হতে হয় অতিথিদেরও। এ যেন এক অলিখিত নিয়ম আজকালকার বিয়ে অনুষ্ঠানগুলোর। এছাড়া বাইরের আলোকসজ্জা, বাদ্য বাজনা, ফটোগ্রাফি ইত্যাদিতো আছেই। সবকিছুই হতে হবে পারফেক্ট, নিখুঁত এবং জাঁকজমকপূর্ণ ও স্মরণীয়। অন্যদের দেখিয়ে দিতে হবে, প্রতিবেশী বা অন্যদের চেয়ে কোন অংশে কম হলে মান সম্মান থাকবেনা। এই যে প্রতিযোগিতা ও অন্যদের চেয়ে ভাল ‘হতে হবে’ কনসেপ্ট মনন ও মগজে ঠাই নিয়েছে, এ এক সামাজিক অসুস্থতা। সমাজবিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘প্রদর্শনবাদীতা’।

প্রদর্শনবাদীতার এই গড্ডালিকা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। আর এই প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাসনিম জারা। কি করেছেন তিনি? এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়েছেন ২০১৭ সালের ৯ই আগস্ট। নিজের বিয়েতে তিনি প্রচলিত সাজে না সেজে বিয়ে করেছেন খুব সাধারণ সাজ পোশাকে, এবং সম্পূর্ণ মেক-আপহীন অবস্থায়। মেক-আপহীন সাজে নিজের বিয়ের মঞ্চে সাবলীলভাবে তিনি করে গেছেন সব প্রয়োজনীয় কর্তব্য কর্ম। মুখে নেই মেক-আপ, হাতে-কানে-গলায় নেই ভারী অলংকার, গায়ে নেই জড়োয়া শাড়ি। দাদীর দেয়া পুরানো আমলের কাতান শাড়ি পরেই বিয়ে সেরেছেন তিনি।

নিঃসন্দেহ তাসনিমের এই সাহসী পদক্ষেপ কাউকে না কাউকে ভাবাবে। যত বেশি মানুষকে ভাবাতে পারে ততই মঙ্গল। তাসনিমের এই পদক্ষেপের কতগুলো সুন্দর আউট কাম আছে। যদিও তাসনিমের এই ‘স্ট্যান্ড’ কে কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ হিসেবে অ্যাখ্যা দেয়া যায় না, এটা কোন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডও নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে তাসনিমের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে জীবনে বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও অকৃত্রিম থাকা দরকার। এতে আনন্দ কমে না, বরং বাড়ে।

তাছাড়া মানুষ অতিরিক্ত সাজসজ্জা ও জাঁকজমক এর আয়োজন করে নিজেকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী প্রমাণ করতে চায় তখনই যখন আসলে সে মনের গভীরে নিরাপত্তা হীনতায় ভোগে। একারণে দেখা যায় অনেকে লোন নিয়েও বিয়ে করে, সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত চাপ নিয়ে বিয়ে করে। ফলে তারা আসলে সত্যিকারের আনন্দ পায় না এসবের মাধ্যমে, শুধুই সামাজিকতার দায়ে আয়োজন ও ঐসব বাহুল্য করে। এই কৃত্রিম বাহুল্যতা তাদের প্রকৃত অবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। তাসনিম এই সাংঘর্ষিক মানসিক অবস্থার মধ্যে নিজেকে বা তার পরিবারকে সম্মুখীন করা থেকে বিরত থেকেছে।

আজকের আধুনিক উচ্চ মাত্রার এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও উর্ধমুখী অসীম চাহিদা মানুষকে শুধু ভোগই করতে শেখায় যার আসলে মহৎ কোন লক্ষ্য নেই। মানুষের এই অসীম ভোগ করার ইচ্ছা সমাজে শুধু বৈষম্যই তৈরি করেনা, অবদান রাখে অমানবিক সমাজ তৈরিতেও। তাসনিম বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজেকে খুব সাধারণ ও সরল মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন যার চাহিদা ও ভোগ নূণ্যতম। এখন সারা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন্ড তৈরি হচ্ছে যা আসলে খুব ইতিবাচক, আর তা হল ‘মিনিমালিস্ট’ হওয়া। একজন মিনিমালিস্ট মানুষ নূন্যতম ভোগ মানে শুধু নিতান্ত প্রয়োজনীয় চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য ব্যাবহার করেন না। এতে তার জীবনের জটিলতা অনেকাংশে কমে যায়। মানুষ হিসেবেও সে হয়ে ওঠে বন্ধু সুলভ, সহমর্মী, হিসেবী এবং সর্বোপরি মানবিক।

তাসনিমের মেক-আপহীন ও নিরভরণ লুক সব প্রদর্শনবাদীতার বিরুদ্ধে একটি সজোর চপেটাঘাত। যদিও তাসনিমকে এমন শক্তিশালী একটি পদক্ষেপ নেবার আগে নিজের পরিবারের সাথেই রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কেননা, মানুষের জীবনে বিয়ে বারবার আসেনা। সবাই চায় নিজের সন্তান বা প্রিয়জনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আনন্দের সাথে পালন করতে, এজন্যই মূলত মঙ্গলানুষ্ঠানের প্রচলন। কিন্তু এই মঙ্গলানুষ্ঠান যখন প্রদর্শনবাদীতা রোগে আক্রান্ত তখন কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে তা নির্মূলে। তাসনিম যুক্তি দিয়ে রাজি করিয়েছেন নিজের বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন এবং ভালবাসার মানুষ খালেদ সাইফুল্লাহকেও। সকলের দোয়া ও সহযোগিতায়ই তাসনিম নিজের বিয়ের মঙ্গলানুষ্ঠানকে স্রেফ প্রদর্শনবাদীতায় রূপান্তরিত হতে দেননি।

তবে তাসনিম জারা তার এই সাহসী কর্মকাণ্ডের আগেই ঘটিয়েছেন আরেক অসাধারণ কাণ্ড। ডাক্তার। তিনি ‘আরোগ্য’ নামক একটি সংগঠনের প্রেসিডেন্ট । এটি মূলত একটি ক্রাউডফান্ডিংয়ের প্ল্যাটফর্ম, যা গরীব অসুস্থ রোগীদের জন্য ফাণ্ড রেইজ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। ২০১৬ সালে সংগঠনটি ইয়ুথ লিডারশিপ পুরস্কার জিতেছিল। তাসনিম জারা পেশায় একজন চিকিৎসক। প্রচলিত ধ্যানধারণার বিপক্ষে গিয়ে স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটার যে দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন তা প্রেরণা জোগাবে সমাজের অনেককে নিঃসন্দেহে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন