আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

পৃথিবীকে বাঁচাতে লড়ে যাচ্ছেন সবুজ যোদ্ধা

সভ্য সমাজ যখন নির্বিচারে বন জঙ্গল উড়িয়ে দিব্যি সুখে দিন কাটাচ্ছে, তখন শওকত ভাবছেন কোথায় একটি গাছ লাগানো যায়। গাছই পুরো পৃথিবীকে আগলে ধরে আছে। গাছ না থাকলে এই পৃথিবীতে প্রানীকূলের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। বয়সের ভাড়ে লুয়ে পড়া শওকত এখনও গাছ লাগিয়ে ও পরিচর্যা করে পোকা মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করছেন।

বৃক্ষপ্রেমী শওকতের পুরো নাম শওকত আলী মাস্টার (৮৫)। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার নাকাই ইউনিয়নের শীতল গ্রামের এক নিভৃত পল্লীতে যার জন্ম। পেশায় একজন নাম করা হোমিও চিকিৎসক। তাকে সবাই শওকত আলী মাস্টার নামেই চেনে। তিনি একজন অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। কৃষক বাবা চয়ন মাহমুদ ও মা আবিজান বেওয়া গৃহিনীর ঘরে তার জন্ম। বাবা মা অনেক আগে মারা গেছেন। বাবার একমাত্র ছেলে তিনি। ১৯৬৯ সালে স্নাতক পাস করেন। ১৯৭০ সালে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতার চাকরি নেন। তখন থেকে ৩৭ বছর ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে খুশকিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে শিক্ষকতা জীবনের অবসর নেন। পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। বড়মেয়ে শাহানা মারা গেছেন। স্বামীর মুত্যুর পর ছোটমেয়ে বিউটি তার সংসারে। দুই ছেলে হিরু ও পাপুল হোমিও চিকিৎসক। স্ত্রী আমিনা বেগম একজন গৃহিনী।

ছোট বেলা থেকেই গাছ লাগানো তার নেশা। শিক্ষকতা জীবনে বেতন তুলে সবার আগে গাছ ক্রয় করতেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে এসব করছেন গাইবান্ধার বৃক্ষপ্রেমি শওকত মাষ্টার। তার আঙিনা কিংবা উঠোনে। ঘরের কোনায় কিংবা পুকুর পাড়ে। বসতভিটা জুড়ে গাছ আর গাছ। সবই বিরল জাতের ফল, ফুল ও ওষুধি। অন্তত ১০০ জাতের গাছ। যেখানেই বিরল জাতের গাছ পান সেখান থেকেই সংগ্রহ করেন। রোপন করেন বসতভিটায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সবুজ প্রকৃতিতে ঘেরা বসতভিটা। আঙিনা, উঠোনে, আনাচে কানাচে কেবল বিরল জাতের গাছ। বৃদ্ধ বয়সেও গাছের পরিচর্যা করছেন তিনি। গাছপাগল এ মানুষটি এলাকা জুড়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। পঞ্চাশ শতক বসতভিটায় প্রায় ১০০ জাতের গাছ। এরমধ্যে এ্যাডোকাবো, করোমচা, নাসপাতি, শরিফা, সবেদা, গোলাপজান, ক্যামেলিয়া, টিউলিপ, মে, ইফোর বিয়া, জবা, সাদা গোলাপ, লাল গোলাপ, বেলী, জুই, গ্লাডিওলাস, হাটব্লিডিং, রঙ্গন, ইকজুরা ফুল, আরবের খেজুর, ড্রাগন ফল, জাফরান, ১০ জাতের আম, জাম, লিচু, জামরুল, বিভিন্ন জাতের পেয়ারা, কমলা, মালটা, ফলসা, কামরাঙ্গা,চায়না কমলা, ঝুড়ি ওরবরই, বিদেশী নারিকেল, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম, কাঠ বাদাম, ওষুধি গাছের মধ্যে আমলকি, হরতকি, বহেরা, অর্জুন, তুলশি, চিরতা, কালো মেঘ, ভিঙ্গরাজ, সুপারি, তাল ও শান্ত ফল, মসলা জাতীয় লং, এলাচ, পান মসলা, কালোজিরা, তেজপাতা, দারুচিনি, সাদা এলাচ, আলু বোখরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিশাল আকৃতির পুকুর পাড় জুড়ে আরও নানান প্রজাতির গাছ বিস্তৃত। দুর থেকে দেখা যায় শুধু সবুজের সমারোহ।

শওকত আলীর স্ত্রী আমিনা বেগম বলেন, তিনি গাছ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। বাজারের টাকা বাঁচিয়ে গাছ কিনে নিয়ে আসেন। তিনি একজন গাছ প্রেমিক মানুষ। নিজেই এখন চলাফেরা করতে পারে না। তাও সকাল বিকাল গাছের পরিচর্যা করেন।

তার ছেলে হিরু জানান, আমি ছোট বেলা থেকেই দেখছি বাবা গাছের পাগল। গাছের চারা দেখলেই কিনবে। অনেক সময় আমরা বিরক্ত হয়েছিলাম। এত গাছ দিয়ে কী হবে বা কি কাজে আসবে? এখন অনেক দূর দুরান্ত থেকে লোকজন আমাদের বাড়িতে আসছেন বিরল প্রজাতির গাছ দেখতে। এসব দেখে ভালই লাগে।

ছোট ছেলে পাপুল মিয়া বলেন, বাবা একজন বৃক্ষপ্রেমি মানুষ। তিনি বয়সের ভারে ঠিকমতে নিজেই চলাফেরা করতে পারে না। কিন্তু তারপরও গাছের পরির্চযা করেন। তিনি গাছ দেখলে বসে থাকতে পারেন না। সকালে উঠেই গাছের দেখাশুনা শুরু করেন।

নাতি রিমন মিয়া জানান, দাদুর গাছের প্রতি এতটা ভালোবাসা। দাদুর চোখে পুরো পৃথিবীটা সবুজের সমারোহের এক অনন্যা। দাদু হয়তো একদিন এই পৃথিবীতে থাকবে না। তার অনুপস্থিতি এসবের রক্ষণাবেক্ষণের ভার আমাদেরকে বহন করতে হবে। সারা জীবন দাদুর লাগানো গাছ গুলো আমরা স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে চাই।

এ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তাকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার দেয়া হয়। বসতভিটায় গাছ লাগিয়ে কৃষির উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপনের স্বীকৃতিস্বরুপ এ পুরস্কার দেয়া হয়। তিনি পুরস্কার হিসেবে ব্রোঞ্জ পদক পান। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও শওকত মাষ্টার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অসংখ্য বার পুরস্কৃত হয়েছেন।

এসব বিষয়ে একান্ত সাক্ষাতকারে জানতে চাইলে শওকত মাষ্টার ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে জানান, ছেলেমেয়ের মতই আমি গাছকে ভালোবাসি। প্রায় সারাজীবন গাছের সঙ্গেই কাটিয়েছি। বাকী জীবনটাও কাটাতে চাই।

এসব বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ মুন্না বলেন, শওকত মাষ্টারের বাড়িতে আমি নিজেই বেশ কয়েকবার গিয়েছি। তার বসতভিটায় শতাধিক বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে।এ ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির গাছও রয়েছে। নিজের চেষ্টায় তিনি এগুলো সংগ্রহ করেছেন। সত্যই তিনি একজন গাছ প্রেমিক মানুষ। তার উদ্যোগ কৃষি ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ বেলাল উদ্দিন বলেন, শওকত মাষ্টার কৃষি ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি এ অবদানের জন্য জেলার মধ্যে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দেয়া হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন