মৃত সাজিয়ে জমি নিয়েছে নাতি, আদালতে জীবিত দাদি
নিজের দাদি এবং বাবাকে মৃত সাজিয়ে প্রায় ৫১ শতক জমি আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তারিফ হোসেন নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দলিল জালিয়াতির একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
গেলো ২৬ অক্টোবর দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, ৭৫ বছর বয়সী শরীফা খাতুন মিরসরাই উপজেলার ৯ নম্বর সদর ইউনিয়নের ৫১ শতক জমির মালিক। শুরুতে তিনি মৃত বলে ওয়ারিশ সনদ বানানো হয়। সনদটিতে তার মেয়ের নাম বাদ দিয়ে একমাত্র ছেলে নিজাম উদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়। এরপর ওই নিজাম উদ্দিনকেও মৃত ঘোষণা দিয়ে আরেকটি ওয়ারিশ সনদ বানানো হয়। ওই সনদে নিজাম উদ্দিনের দুই ছেলে এবং স্ত্রী উত্তরাধিকার বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও নিজাম উদ্দিনের দুই মেয়ে রয়েছে। এরপর নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী এবং এক ছেলের সম্পত্তি বড় ছেলে তারিফ হোসেনকে হেবা (দান) করে দিয়েছেন বলে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে বানানো সেই দলিল দিয়ে বৃদ্ধা শরীফা খাতুনের সম্পত্তি সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে নামজারি করে নেয়া হয়।
এ ঘটনা জানতে পেরে কোনো উপায় না দেখে মৃত সাজানো বৃদ্ধা শরীফা খাতুন দ্বারস্থ হন আদালতের। বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে জীবিত আছেন বলে জানান। মামলায় নাতি তারিফ হোসেন (২৪), শরীফুল ইসলাম (১৯) এবং পুত্রবধূ কামরুন নাহারকে (৪৫) বিবাদী করেন শরীফা খাতুন।
এদিকে মামলার আবেদন শুনে ও নথি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এক মাসের সময় বেঁধে দেন আদালত। তবে চাঞ্চল্যকর এই মামলা দায়েরের দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনও দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। উল্টো বাদীকে ঘনঘন পিবিআই অফিসে না আসার জন্য বলেন তদন্ত কর্মকর্তা।
তবে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগ অস্বীকার করে কার্যক্রম চলমান আছে বলে দাবি করেন।
স্থানীয়দের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে ও ভুক্তভোগী বৃদ্ধার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শরীফা খাতুনের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সদর ইউনিয়ন এলাকায়। ১৯৮৫ সালে তার স্বামী রেনু মিয়া নিজের পৈতৃক বাড়ি বিক্রির টাকার কিছু অংশ দিয়ে মোট ১৪৫ শতক জমি ক্রয় করেন। এসবের মধ্যে স্ত্রী শরীফা খাতুন ও ছেলে নিজামের নামে ৫১ শতক করে কেনেন। বাকী ৪৩ শতক রাখেন নিজের নামে। এরপর ২০২০ সালে নিজের অংশ মেয়ে নুরজাহান বেগমকে হেবা করে দেন তিনি। ৫১ শতক জমি নিজাম নিজে ভোগ করে আসছে। আর ৫১ শতাংশ মা শরীফা খাতুনের দখলে ছিল। এরপরই সেই জমিতে নজর পড়ে নিজাম উদ্দিনের ছেলে তারিফ হোসেন ও তার মা কামরুন নাহারের।
নথি পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, ৫১ শতক জমি নিজের করতে শুরুতে শরীফা খাতুন মৃত বলে ওয়ারিশ সনদ বানান তারিফ। মিরসরাই সদর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চলতি বছরের ১৫ মে ইস্যু করা হয় ওই সনদ। ১০৪/২২ নম্বরের সনদটিতে শরীফা একমাত্র ছেলে নিজাম উদ্দিনকে উত্তরাধিকার রেখে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। সে হিসেবে ৫১ শতক জমির মালিক হন নিজাম। যদিও শরীফা খাতুনের নুরজাহান নামে এক মেয়ে রয়েছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজাম উদ্দিনকে মৃত সাজিয়ে আরেকটি ওয়ারিশ সনদ বানানো হয়। ১৫ মে তারিখে সনদটিও মিরসরাই সদর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ইস্যু করা হয়। ১০৫/২২ নম্বরের সনদটিতে নিজাম উদ্দিন মৃত্যুকালে স্ত্রী কামরুন নাহার, ছেলে তারিফ হোসেন ও শরীফুল ইসলামকে উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও নিজাম উদ্দিনের তাহমিনা আক্তার ও ফাহিমা আক্তার নামে দুই মেয়ে রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
ওয়ারিশ সনদ দুটির বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামছুল আলম বলেন, সনদ দুটি কোনো দোকান থেকে স্ক্যান করে বানানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এরকম কোনো সনদ দেয়া হয়নি। পরিষদ থেকে দেয়া ১০৪/২২ নম্বর ওয়ারিশ সনদটি মৃত উজ্জ্বল মিয়ার। এছাড়া ১০৫/২২ নম্বর সনদটি মৃত বিবি সলিমার উত্তরাধিকারদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছে। এই দুটি সনদের ফটোকপি আমি শরীফা খাতুনকে দিয়েছি।
এদিকে, দুটি ওয়ারিশ সনদ বানিয়ে শরীফা খাতুনের সম্পত্তির মালিক বনে যান তারিফ হোসেন, তার ভাই শরীফ এবং মা কামরুন নাহার। এরপর ২২ মে স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে গিয়ে কামরুন নাহার ও তার ছেলে শরীফের অংশ তারিফকে দান করে দেন। ২৯০৬ নম্বর দান ঘোষণাপত্র অনুযায়ী- ৫১ শতক জমির মালিক হয় তারিফ। একপর্যায়ে তারিফ এসব জমি নিজের নামে খতিয়ান সৃজন করতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে আবেদন করেন। কোনোপ্রকার তদন্ত ছাড়া আবেদন মঞ্জুর হলে তারিফ হোসেনের নামে ৩০৯৭ নম্বর খতিয়ান সৃজন হয়।
জানতে চাইলে হেবা দলিল লেখক খোরশেদ আলম বলেন, আমি আট বছর ধরে দলিল লিখি। এ ধরনের ওয়ারিশ সনদ জাল করার ঘটনা এবারই প্রথম। আমার কাছে তারিফ এবং তার মা কামরুন নাহার এসে দলিলটি লিখিয়েছেন। আমি কাগজপত্র অনুযায়ী লিখে দিয়েছি। ওয়ারিশ সনদ জাল ছিল আমি জানতাম না। পরে শুনি নিজাম উদ্দিন এবং শরীফা খাতুন দুজনেই জীবিত আছেন।
তদন্ত ছাড়া তারিফের নামজারি আবেদন অনুমোদনের বিষয়টি জানতে মিরসরাইয়ের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মিজানুর রহমান ও একই কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মো. তোফায়েল আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত তারিফের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে তাদের পারিবারিক নম্বরে ফোন করলে অভিযুক্তর ছোট ভাই শরীফুল ইসলাম রিসিভ করেন। তিনি শুরুতে ঘটনার বিষয়টি অবহিত নয় বলে দাবি করেন। এমনকি পিবিআইয়ের কাছে তদন্তে থাকা মামলার বিষয়টিও অবহিত নন বলেও দাবি করেন।
তবে কথাবার্তার একপর্যায়ে তিনি জানান, এরকম নামজারি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। এক প্রতিবেশী থেকে আমরা ১০ লাখ টাকা পাই। তিনি হয়তো আমাদের ফাঁসানোর জন্য জালিয়াতির কাজটা করতে পারেন। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে ভূমি অফিস থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আমরা তাদের বলেছি- জায়গাটি নিয়ে আমাদের কোনও দাবি নেই। এরপর শুনেছিলাম বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শরীফা খাতুন বলেন, বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে আমি মেয়ের বাড়িতে থাকি। ছেলের বউ ও নাতিরা মিলে জাল দলিল করে আমার সম্পত্তি লিখে নিয়েছে। এই বুড়ো বয়সে আমাকে আদালত ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। পিবিআই অফিসেও আমরা দুইবার গেছি। কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছি না।
পিবিআইয়ের তদন্তে ধীরগতির বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে শরীফা খাতুনের আরেক নাতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আদালত পিবিআইকে একমাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার আদেশ দিয়েছেন। আমরা দুইবার তাদের অফিসে গিয়েছিলাম। তবে দ্বিতীয়বার যাওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা আমাদের ঘনঘন অফিসে যেতে বারণ করেন। কেন করেছেন জানি না। আমরা চাই পিবিআই দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন এবং আমরা ন্যায়বিচার পাব।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, আমার মৃত সাজানো মক্কেল শরীফা খাতুন জীবিত। তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে মামলাটি করেছেন। এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্ত করতে পিবিআইকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। আদালতের আদেশ মোতাবেক যথাসময়ের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন দাখিল করা উচিত ছিল। যাই হোক ন্যায়বিচারের স্বার্থে পিবিআই সুষ্ঠু প্রতিবেদন দ্রুত সময়ের মধ্যে দাখিল করবে বলে আশা করছি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটে কর্মরত পরিদর্শক মো. আকতার হোসেন বলেন, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। বাদীপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বাদী যেহেতু বৃদ্ধা, তাই ঘনঘন অফিসে আসতে মানা করেছি। সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে চিঠির উত্তর এলে বিবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তাদের ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে যাবতীয় প্রমাণ সংগ্রহ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, মনে হচ্ছে এ ধরনের জালিয়াতিতে স্থানীয় একটি চক্র জড়িত। ওই চক্রটিকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। যেহেতু জালিয়াতি মামলাটি দালিলিকভাবে প্রমাণ করতে হবে, সেজন্য বাদীপক্ষকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।