আর্কাইভ থেকে অপরাধ

জঙ্গিদের আত্মঘাতী হওয়ার মন্ত্রণা দেয়ার অপরাধে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার নিখোঁজ গুনবী

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলামের’ কথিত আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবী ওয়াজের আড়ালে জঙ্গিবাদী মতার্দশ প্রচার করে সাধারণ জঙ্গিদের ‘আত্মঘাতী’ হতে উদ্বুদ্ধ করতেন বলছে র‌্যাব।

৩৬ বছর বয়সী এই জঙ্গি নেতাকে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) রাতে মিরপুরের বেড়িবাঁধ থেকে উগ্রবাদী বই ও লিফলেটসহ গ্রেপ্তারের পর র‍্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন শুক্রবার (১৬ জুলাই) এসব তথ্য জানান।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারের র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গুনবী মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস পড়ে ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সজারের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি ধর্মীয় মতাদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন।

২০১০ সাল থেকে তিনি ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন। ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে ধর্মীয় বক্তব্যে উগ্রবাদিত্ব প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন দাবি করে র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, গুনবী প্রথমে জঙ্গি সংগঠন হুজি (বি) সঙ্গে যুক্ত হন। জঙ্গি নেতা জসীমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলে তিনি আনসার আল বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

“জসীমউদ্দিন রাহমানীকে গ্রেপ্তারের পর গুনবী ‘উগ্রবাদিত্ব প্রচারক’ হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন; আনসার আল ইসলামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।”

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আমির মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন।

ওই হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা ও হত্যার পেছনে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি। ওই বছর মে মাসে সরকার এ জঙ্গি দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

আনসারুল্লাহ নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ দলের সদস্যরা আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা শুরু করে বলে সে সময় খবর দেন গোয়েন্দারা। পরে ২০১৭ সালের মার্চে আনসার আল ইসলামকেও সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

আনসার আল ইসলামের নেতা হাসান গুনবী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাদ্রাসায় বক্তা হিসেবে গিয়ে সেখানে শিক্ষকতা ও মাদ্রাসা পরিচালনায় সম্পৃক্ত হয়ে তিনি জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য।

র‌্যাবের মুখপাত্র মঈন বলেন, “আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি ছিল গুনবীর। সাধারণ জঙ্গিদের ‘মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন’ ঘটিয়ে তাদের আত্মঘাতী হতে উদ্বুদ্ধ করায় ভূমিকা রাখতেন।”

‘আধ্যাত্মিক নেতার’ ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গুনবীর বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অনেক। গ্রেপ্তার জঙ্গি সাকিব জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গুনবী তাদের কাছে ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ হিসেবে পরিচিত। বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের মতাদর্শ পরিবর্তন করার একটি ক্ষমতা তার মধ্যে আছে।”

গত ৫ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা জঙ্গি আল সাকিব গ্রেপ্তার হয়। আধ্যাত্মিক নেতা গুনবীর মাধ্যমেই সাকিব আত্মঘাতী হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানিয়েছে।এই সাকিব ঢাকায় পুলিশের উপর এবং সংসদ ভবন এলাকায় হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন।

খন্দকার মঈন বলেন, “একাধিক ধর্মীয় সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গুনবী জড়িত ছিলেন। সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে।”

এদের সাইফুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, আনিছুর রহমান ও হাসানের নাম উল্লেখ করেন র‌্যাব কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “সংগঠনের ভেতরে উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচারে গুনবী ‘ছায়া সংগঠন’ পরিচালনা করতেন। ‘মানহাজি’ সদস্য হিসেবে পরিচিত এই সংগঠনের সদস্যরা ভেতরে জঙ্গি সদস্য তৈরি করত। বিভিন্ন ইস্যুতে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদ উসকে দিত।

“গুনবী ‘দাওয়াত ইসলাম’-এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তির বিশেষ উদ্যোগ নেন। তিনি মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য সংগ্রহ করতেন।”

আনসার আল ইসলামের মানহাজি সদস্যের সংখ্যা জানতে চাইলে এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, “এখন পর্যন্ত তিন জন মানহাজির সন্ধান আমরা পেয়েছি।”

গুনবীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা দেখেছি সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের কাজ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছে। ওই সংগঠনের বিভিন্ন মিটিং বা মাহফিলে যোগ দান করলেও তার কোনো সাংগঠনিক পদ ছিল না।

“তবে দাওয়াতে ইসলামের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ঘরে ওঠে। পরবর্তীতে সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।”

হেফাজত ইসলামের সঙ্গে গুনবীর কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরাসরি এই সংগঠনের তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে এর বিভিন্ন সমাবেশে তিনি যোগ দিয়েছেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার জঙ্গি ওসামার সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়ে গুনবী স্বীকার করেছে জানিয়ে মঈন বলেন, “রাজবাড়ীতে ওসামার যে মাদ্রাসা রয়েছে সেখানে সে নিয়মিত মাহফিলে বক্তব্য দিত এবং উগ্রবাদী আদর্শ প্রচার করত। সেই মাদ্রাসায় সে একজন প্রতিষ্ঠিত উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত ছিল।

“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে এসেছে ওসামা ও সাকিবের যে পরিকল্পনা ছিল সেখানে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। আর এই হামলার পরিকল্পনায় তার গাইডলাইন ছিল।”

সংসদ ভবনে তলোয়ার নিয়ে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে গত মে মাসে আবু সাকিব ওরফে আল আমিন নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করার পর রাজধানীর শেরে-বাংলা নগর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা হয়েছিল, সেখানে হাসান গুনবীর নামও ছিল।

মামলার এজাহারে বলা হয়, সাকিব নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তিনি মোবাইল ফোনে নিয়মিত আলী হাসান ওসামা, মাহমুদুল হাসান গুনবী, আমির হামজা, হারুণ ইজহারের ওয়াজ শুনতেন। সেসব ওয়াজে যেসব বার্তা প্রচার করা হত, তাতেই তিনি ‘উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ’ হন এবং ‘তলোয়ার নিয়ে সংসদ ভবনে হামলার’ পরিকল্পনা করেন। ওই ওসামাকেও পরে গেপ্তার করা হয়।

গত ৬ জুলাই মহাখালী থেকে গুনবীকে র‍্যাব তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে মঈন বলেন, তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। গতকাল তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় উগ্রবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাহফিলে বক্তব্য দিতেন। তবে তার সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিলে উত্তরবঙ্গ হয়ে দেশ ত্যাগের।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “র‍্যাব এখন পর্যন্ত ৩৭০ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তারা আফগানিস্তানে যাবে বা তালেবানদের সঙ্গে যুক্ত হবে।

“তবে তাদের মধ্যে উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এক শ্রেণির স্কলার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের অনেক স্কলারকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি এবং তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।"

রাজধানীর কোন এলাকায় জঙ্গিদের তৎপরতা বেশি জানতে চাইলে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, “র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মিরপুর এলাকায় জঙ্গিদের তৎপরতা বেশি। আমরা প্রচুর পরিমাণে জঙ্গি মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছি।”

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন