সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ে মিলিয়ন ডলারের ভুয়া কাগজপত্র
মার্কিন কোম্পানি ‘আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশন’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের ‘সারা এন্টারপ্রাইজ’। মার্কিন কোম্পানিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়, ডিরেক্টরেট জেনারেল ডিফেন্স পারচেজের (ডিজিডিপি) মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের সামরিক সরঞ্জামের ক্রয়াদেশ। এসব সরঞ্জাম কেনার আগে সারা এন্টারপ্রাইজের ৬ জনকে প্রশিক্ষণ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা অনুমোদনের গ্যারান্টি দেয়ার অনুরোধ করা হয় আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনকে।
ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও বলা হয় কোম্পানিটিকে। ওই কোম্পানিটি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে জানালে তদন্তে বেরিয়ে আসে নেপথ্যের কাহিনী। মূলত মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ওই ৬ জনকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে বেছে নেয়া হয় অভিনব এই পন্থা।
ভুয়া ক্রয়াদেশ পাঠিয়ে ভিসা প্রাপ্তির আবেদন করা চক্রের মূলহোতাসহ ৭ জনকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
গ্রেফতাররা হলেন- মূলহোতা মো. রেজাউল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, মো. আজিজুর রহমান, মো. খায়রুল কবির, সাদেকুর রহমান, মো. শাহরিয়ার হোসেন বিক্রম ও মুহাম্মদ আবু বক্কর।
তাদের কাছ থেকে ২০টি জাল সিল, ২টি সিল প্যাড, ৯টি পাসপোর্ট, ৪টি ভুয়া আইডি কার্ড, একটি পেনড্রাইভ, ২টি মোবাইল ফোন ও বিপুল পরিমাণ জাল কাগজপত্র জব্দ করা হয়।
ডিবি বলছে, ডিজিডিপির ভুয়া ক্রয়াদেশ দেখিয়ে প্রতারক রেজাউল দীর্ঘদিন ধরে ইতালি, পোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন। এজন্য প্রতি জনের কাছ থেকে ১৮-২০ লাখ টাকা করে নিতেন তিনি। সবশেষ একই কায়দায় সামরিক সরঞ্জাম কেনার ভুয়া ক্রয়াদেশ বানিয়ে ৬ জনকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে গিয়ে ধরা পড়েন রেজাউল।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সবুজ আলম নামে একজন আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনকে ডিজিডিপির ক্রয়াদেশ উপস্থাপন করেন।
ডিজিডিপির ক্রয়াদেশ যাচাই বাছাই করে জানতে পারে, নথিতে উল্লিখিত সিলসমূহ জাল, নথিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তি (মেজর মো. বসির আহমেদ) ৫ বছর আগে ডিজিডিপিতে চাকরি করতেন। এছাড়া টেন্ডার নম্বর- ২১১.৩৯৯ এফ.২২ (তারিখ ২০-০৩-২২) নথিটি জাল। পরে গেলো বুধবার গুলশান থানায় মামলা (নম্বর-৭) করে দূতাবাস। ওই মামলার সূত্র ধরেই ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. মনিরুল ইসলাম জানান, আমেরিকান কোম্পানির কাছে সারা এন্টারপ্রাইজ দাবি করে, তারা ১.২ মিলিয়নের অধিক মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি। তারা মার্কিন কোম্পানিকে ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সারা এন্টারপ্রাইজের ৬ জনের ভিসা অনুমোদনের গ্যারান্টি দেয়ার অনুরোধ করে। মূলত ওই ৬ ব্যক্তির প্রশিক্ষণ গ্রহণের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তারা এই প্রতারণামূলক কাজটি ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অভিবাসনের জন্য মার্কিন ভিসা পেতে ব্যবহার করেছিল।
তিনি বলেন, গ্রেফতার রেজাউল ২০১১-১২ সালে নিজ কোম্পানি ডিফেন্স আইকনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লোকাল টেন্ডারে চাল-ডাল ইত্যাদি সরবরাহ করতেন। সরকারি কাজের সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি প্রতারণার কৌশল রপ্ত করেন। তিনি ডিজিডিপির ক্রয় পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষভাবে পারদর্শী। পরবর্তী সময়ে তার এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০১৪-১৫ সাল থেকে ১৮-২০ লাখ টাকার বিনিময়ে এ ধরনের প্রতারণা করে আসছেন। রেজাউল একাধিক পরিচয় দিতেন। তিনি নিজেকে কখনো সবুজ আলম, কখনো মেজর বসির পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন।
জানতে চাইলে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, মূলত সারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রেজাউল নিজেকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দিয়ে অন্য গ্রেফতার আসামিদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অবৈধ পথে আমেরিকায় পাঠানোর চেষ্টা করছিলেন। ইউএসএ ভিসা প্রাপ্তির জন্য তারা পরস্পর যোগসাজশে জাল সিল ও নকল কাগজপত্র তৈরি করেন। রেজাউল নিজেকে সারা এন্টারপ্রাইজের মালিক সবুজ আলম পরিচয়ে ইউএসএ, ইতালি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশের নামিদামি কোম্পানির কাছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মালামাল সরবরাহের জন্য ক্রয় চুক্তি করে থাকেন। কিন্তু চক্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন লোকদের বিদেশে পাঠানো।
এ বিষয়ে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়- ইউএসএ তথা বিভিন্ন উন্নত বিশ্বের ভিসা প্রাপ্তির জন্য অবশ্যই সঠিক তথ্য ও কাগজপত্র অ্যাম্বাসিতে প্রদর্শন করার জন্য অনুরোধ করা হলো। জাল কাগজপত্র প্রদর্শনকালে আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে এবং আপনি ভিসা প্রাপ্তির জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
এছাড়া জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করা ও জাল সিল ব্যবহার বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ। সবাইকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো। ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার ভিসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে না। অজ্ঞাতে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলে ডিবিকে অবহিত করতে বলা হয়।