আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

তিন সাঁওতাল হত্যার দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে: সুলতানা কামাল

বিগত পাঁচ বছরেও তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার হয়নি। একটি জাতি যখন সেই দেশে ঘটানো অন্যায় ও অপরাধের বিচার করে না, সেই কলঙ্ক কিন্তু জাতির গায়েও লাগে। আমরা এদেশের সচেতন নাগরকি হিসেবে তা মেনে নিতে পারি না। আমরা এই কলঙ্ক বহন করতে রাজি নই। বললেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, রাষ্ট্র যদি এখানে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে, বিচার না করে, সেই কলঙ্কের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আমরা বারবার এই হত্যার বিচার দাবি করব।

শনিবার (৬ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটামোড় এলাকায় সাঁওতাল দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে এসব কথা বলেন।

সুলতানা কামাল বলেন, আমরা বারবার মনে করিয়ে দিবো রাষ্ট্র তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেছে। আমরা তিন সাঁওতাল হত্যার হত্যার বিচার দেখতে চাই। যারা এই অপকর্ম করেছিলো, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হোক। 

তিনি আরও বলেন, যতদিন এই তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার না হবে, আমরা বাঙ্গালী সাঁওতাল সবাই মিলে আন্দোলন চালিয়ে যাব। যতদিন পর্যন্ত এই বিচার সম্পন্ন না হবে ততদিন পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াবো না। 

সুলতানা কামাল বলেন, সরকারের অনেক জায়গা থাকতে, বাগদা ফার্মেই কেন ইপিজেড করতে হবে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এখানে ইপিজেড নির্মাণ চলবে না। আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে রয়েছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার উল্লেখ করছেন তিন ফসলী জমিতে কোন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে না। কারণ বাংলদেশে অনেক খাস ও পতিত জমি রয়েছে। যেখানে শিল্প কারখানা করা যায়। শিল্প কারখানা হলে উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থান হবে। সবঠিক আছে, কিন্তু সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জমির দিকে সরকারের নজর পড়ে কেন? তাদের জীবিকা যেখান থেকে আসে, যেখানে তারা উৎপাদন করেন। নিশ্চয়ই এর পিছনে কারণ আছে। সরকার কখনও কোনো জনগোষ্ঠীকে বাস্তচ্যূত করতে পারে না। সেই জায়গায় আমাদের জোর দিয়ে কথা বলতে হবে। তাদের কাছে এই বার্তা পৌছে দিতে হবে। আমরা নানাভাবে এই বার্তা সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। আন্দোলনের মাধ্যমে এখানে ইপিজেড নির্মানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য করব। 

শনিবার সকাল থেকে নানা আয়োজনে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল হত্যা দিবস পালিত হয়েছে। সকাল আটটায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার জয়পুর গ্রামে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে পুস্পস্তবক অর্পন ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়। সকাল নয়টায় সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম থেকে তির ধনুক, ব্যানার, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত ফেস্টুন শোভিত একটি শোক মিছিল বের হয়। মিছিলটি ১৫ কিলোমিটার পথ প্রদক্ষিণ করে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর সড়কের কাটামোড়ে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সকাল সাড়ে ১১ টায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের শুরুতে শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপর প্রতিবাদী গণসংগীত পরিবেশিত হয়। 

তিন সাঁওতাল হত্যা, সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের জমিতে তোলা বাড়ি ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগের বিচারের দাবিতে এসব কর্মসূচি পালিত হয়। সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) ও জনউদ্যোগ যৌথভাবে এসব কর্মসূচি পালন করে। 

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে। 
বক্তব্য দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, এএলআরডির প্রধান নির্বাহী শামসুল হুদা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদর আহবায়ক সিরাজুল ইসলাম ও সদর শাখার আহবায়ক গোলাম রব্বানী, সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব জাহাঙ্গীর কবীর, জেলা জাসদ সভাপতি গোলাম মারুফ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সবিন মুন্ডা, নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের সদস্যসচিব প্রবীর চক্রবর্তী, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন শেখ, সুফল হেমব্রম, প্রিসিলা মুর্মু ও অলিভিয়া হেমব্রম প্রমুখ। 

বক্তারা সাঁওতাল হত্যা দিবসে আটদফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। দাবিগুলো হচ্ছে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের জমিতে ইপিজেড নির্মাণ বন্ধ, তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার, বাপ-দাদার জমি ফেরত, নিহতদের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং নিজস্ব ভাষায় পরিচালিত করা, স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন, বাড়ি-ঘরে লুটপাটের ক্ষতিপূরণ, সাঁওতালদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও চিনিকলের জমি লিজ নেয়া লুটপাটকারিদের বিচার। 

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে নয়জন পুলিশ সদস্য তীরবিদ্ধ ও চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে তিন সাঁওতাল শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ মারা যান। পরবর্তীতে পুলিশ এক অভিযানে ওই বসতি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে। এইসব ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে স্বপন মুরমু বাদি হয়ে গত ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করেন। পরে ২৬ নভেম্বর থোমাস হেমব্রম বাদি হয়ে উপজেলার সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল আহম্মেদসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে আরেকটি মামলা করেন। 

পরবর্তীতে হাইকোর্ট মামলা দুইটি এক করে পিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গাইবান্ধা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৎকালীন সহকারি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল হাই সাঁওতাল হত্যা মামলার চুড়ান্ত অভিযোগপত্র গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতে জমা দেন। এই মামলার গুরত্বপুর্ণ ১১ জন আসামির নাম বাদ দিয়ে ৯০ জনের নামে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। 

একই সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামলার বাদি থোমাস হেমব্রম অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। আদালত শুনানী শেষে ওইবছরের (২০১৯ সাল) ২৩ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক পার্থ ভদ্র অধিকতর তদন্ত করতে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন। সিআইডি ২০২০ সালের ২ নভেম্বর আদালতে একই ধরণের অভিযোগপত্র দাখিল করে। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি বাদি থোমাস হেমব্রম পুনরায় নারাজি করেন। এই নারাজির উপর গত ১২ সেপ্টেম্বর শুনানী করে আদালত। 

বাদি পক্ষের আইনজীবি ও জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আগামি ৭ ডিসেম্বর নারাজি শুনানীর উপর আদেশ হবার কথা। তিনি আরও বলেন, পিবিআই ও সিআইডি উভয় কর্তৃপক্ষ মুল আসামিসহ ১১জনকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ফলে সাঁওতালরা চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। 

এস

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন