ধরাকে সরা জ্ঞানই হলো নোবেলের পতনের কারণ
অতি অল্প সময়ে দুই বাংলার সুপারস্টার হয়ে ওঠা গায়ক মাইনুল আহসান নোবেল। যার উত্থানটা হয়েছিল কলকাতার জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘সারেগামাপা’ থেকে। এখান থেকেই যেন শুরু হলো নোবেলের অধঃপতন। অল্প সময়ে জন্ম দিয়েছেন একের পর এক বিতর্ক। কটূ মন্তব্য থেকে শুরু প্রতারণার অভিযোগ, তার গুণের যেন শেষ নেই।
শনিবার (২০ মে) নোবেল গ্রেপ্তার হলেন পুলিশের হাতে। আর সেই খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই নোবেলের পুরনো থেকে নতুন সব বিতর্ক প্রকাশ পাচ্ছে।
২০১৯ সালে নোবেল প্রথম বিতর্কে জড়ালেন তাকে ‘সারেগামাপা’-তে তৃতীয় ঘোষণা করার পর। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নোবেলভক্তদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। ভক্তদের পক্ষে এমন আচরণ খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। প্রিয় মানুষকে নিয়ে তারা এমন করবেন, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন নোবেল স্বয়ং এ বিষয়ে মুখ খুললেন, তখনই শুরু হলো আসল বিতর্ক। যে বিচারকরা একসময় তার চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে সত্যিই আশাবাদী ছিলেন, জিততে না পেরে সেই বিচারকদেরই একহাত নিয়েছিলেন এ সংগীতশিল্পী।
এরপর প্রকাশ্যে আসে আরও এক বিতর্কের ঘটনা। ‘সারেগামাপা’ চলাকালীন এক বিচারককে নাকি নোবেল বলেছিলেন— আমার গান বিচার করার ক্ষমতা আপনার নেই।
এ ঘটনার পর নাকি বেশ কিছু দিন জি বাংলা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নোবেলকে সাসপেন্ড করে রেখেছিল। অভিযোগ ওঠে, শুধু বিচারকদের সঙ্গেই নয়, ওই শোর অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গেও নোবেল নাক উঁচু ভাব নিয়ে চলতেন। কাউকেই বিশেষ একটা পাত্তা দিতেন না। এমনকি এও বলেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো শিল্পীকেই তার যথাযোগ্য মনে হয় না।
এমনকি তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়েও মন্তব্য করেছিলেন। একটি টিভি চ্যানেলে লাইভ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় নোবেল জাতীয় সংগীত নিয়ে যা বলেছিলেন, তারপর পুরো দেশ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। নোবেল বলেছিলেন, আমি রবীন্দ্রনাথের লেখায় নয়, প্রিন্স মাহমুদের লেখায় আমার দেশকে বেশি ভালোভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে বলে মনে করি। কারণ এই গানটির সঙ্গেই বাংলাদেশের আসল আবেগ জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে, বাংলার মানুষের সঙ্গে এই গানের আত্মিক যোগ অনেক বেশি। এমনকি জেমসের ‘বাংলাদেশ’ গানটি জাতীয় সংগীত করা উচিত বলেই আমি মনে করি।
নোবেলের ওই সাক্ষাৎকার দেখে পুরো দেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এর পর থেকেই সে দেশের সংগীত জগতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে শুরু করেন নোবেল।
তারপরও বিতর্কিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেননি নোবেল। যখনই তার কোনো গান মুক্তি পেয়েছে, ঠিক তার আগে কোনো না কোনো বিষয়ে মুখ খুলে নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। নিন্দকরা বলেন, আসলে উনি এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই করেন। এটা গান মুক্তির আগে নেগেটিভ পাবলিসিটি। তবে নোবেল নিজের আবার একাধিকবার দাবি করেছেন যে, এগুলো তিনি নিজে বলেননি। তার ফেসবুক পেজ হ্যাক হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছিল। যদিও নোবেলের বারংবার এমন আচরণের কারণে কমবেশি ২৫টি গান বাতিল করে দিয়েছিল বাংলাদেশের এক রেকর্ডিং কোম্পানি। এমনকি বহু সিনেমা থেকেও বাদ গেছে তার গান।
সম্প্রতি এ গায়ক ফের বিতর্কে জড়িয়েছিলেন এক কলেজের অনুষ্ঠানে। একেবারে মত্ত হয়ে স্টেজে উঠেছিলেন তিনি। তার পর গান গাওয়ার বদলে মাইক হাতে নিয়ে অসংলগ্ন আচরণ করছিলেন দর্শকদের সামনে। এর পরই ক্ষুব্ধ শ্রোতারা নোবেলের দিকে জুতা, পানি ছুড়ে মারে। সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জোর বিতর্ক ছড়ায় দেশে। এর পরই তার সাবেক স্ত্রী সালসাবিল নোবেলের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ আনেন। শুধু তাই নয়, এই মাদকের ব্যবসায় বাংলাদেশের বহু ক্ষমতাশালী ব্যক্তি জড়িত বলেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেন। নেশা না ছাড়ার কারণেই সম্প্রতি তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সালসাবিল।
অবশেষে শনিবার নোবেলকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। দিন দুয়েক আগে মতিঝিল থানায় করা প্রতারণা মামলায় তাকে হাজতে ঢুকিয়েছে পুলিশ।
এ মুহূর্তে জেলবন্দি নোবেল। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের শিল্পী মহলও মুখে কুলুপ এঁটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো প্রতিবাদ নেই নোবেলভক্তদের। কেউ কেউ বলছেন, এমনটিই হওয়ার ছিল।
তাদের দাবি, নোবেল খ্যাতি পেয়েছিলেন হঠাৎ করেই। কিন্তু তাতেই ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন। অগ্রজ শিল্পীদের অপমান, কাছের মানুষদের সঙ্গে নোংরা ব্যবহার। সর্বোপরি নিজের সংগীত, নিজের সাধনাকে যথোপযুক্ত সম্মান না দেয়া— সব মিলিয়ে নোবেলের এ পরিণতি যেন খুবই স্বাভাবিক ছিল।