র্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনার নতুন মোড়
নতুন মোড় নিতে শুরু করেছে নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গেলো সোমবার (২৯ মে) নওগাঁ সার্কিট হাউসে এসে সুলতানা জেসমিনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই জেসমিন ও যুগ্ম সচিব এনামুল হকের মাঝে বিকাশে লেনদেনসহ জেসমিনের রেখে যাওয়া ৪৬টি চিরকুটে কী ছিল তা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
সুলতানা জেসমিনের মামা নাজমুল হক মন্টু গণমাধ্যমকে বলেন, ভাগনির (জেসমিন) রেখে যাওয়া ৪৬টি চিরকুট থেকে তার সঙ্গে এনামুল হকের প্রত্যেকটা লেনদেনের তথ্য আমরা পেয়েছি। জেসমিনকে পদোন্নতি পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা উৎকোচ নিয়েছিলেন এনামুল। পরে জেসমিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জয়পুরহাট ও ঢাকা জেলার বিভিন্নজনের থেকে প্রায় ২২ লাখ টাকা নেন এনামুল। প্রথমে এসব টাকা জেসমিনের অ্যাকাউন্টে নিয়ে সেদিনই তা উত্তোলন করা হয়েছে এবং বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে এনামুল টাকা গ্রহণ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিনেও পদোন্নতি না পাওয়ায় জেসমিন যখন এনামুলের এসব তথ্য ফাঁস করে দিতে চেয়েছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে হত্যাচেষ্টা শুরু করা হয়। র্যাবের হাতে আটকের আগে বেশ কয়েক দিন ধরে জেসমিনের বাড়িতে কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন পরিচয়ে গিয়েছেন। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার অজুহাত দেখিয়ে একজন রাতে গিয়ে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। হয়তো ওই দিন রাতে বাড়িতে ঢুকলে র্যাব তাকে মেরে সব প্রমাণ নিয়ে চলে যেত। বিকাশ ও নগদে লেনদেনের তারিখ, নম্বরসহ এনামুল সম্পর্কে অনেক কিছুই জেসমিন চিরকুটে লিখে রেখেছিলেন। যা তদন্ত কমিটির কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি।
জেসমিনের ভাই সুলতান মাহমুদ সোহাগ বলেন, ওই দিন র্যাবের আটকের প্রক্রিয়াটা অবৈধ ছিল। তাকে আটকের পর কীভাবে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল তার সিসিটিভি ফুটেজ আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি। সেখানে তাকে দেখে কোনোভাবেই স্ট্রোকের রোগী মনে হয়নি। তার কোনো অসুস্থতা ছিল না। তাই বোনের মৃত্যুর জন্য এখনও আমরা পুরো পরিবার র্যাবকেই দায়ী করছি। আশা করি উচ্চ আদালতের এ তদন্ত কমিটি প্রকৃত সত্য উৎঘাটন করে দোষীদের আইনের আওতায় আনবে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সঠিক সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলে কারা দোষী তা সবার সামনে বেরিয়ে আসবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, সুলতানা জেসমিন ও যুগ্ম সচিব এনামুলের মাঝে আর্থিক লেনদেনের কিছু তথ্য তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের কাছে দিয়েছেন। জেসমিনের পরিবারের সদস্য, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, প্রত্যেকের সঙ্গেই পর্যায়ক্রমে কথা বলা হচ্ছে। আমরা তদন্ত কমিটির সদস্যরা এখনও নওগাঁতে আছি। নির্ধারিত সময়ের আগেই উচ্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রসঙ্গত, র্যাব হেফাজতে নওগাঁর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় উচ্চ আদালতের এক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গেলো ২২ মে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটির প্রধান করা হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন খানকে। কমিটির অন্যান্য সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, নওগাঁর সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও নওগাঁর পুলিশ সুপারের মনোনীত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
এর আগে র্যাব-৫-এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের একটি দল গেলো ২২ মার্চ রাজশাহী স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক যুগ্ম সচিব এনামুল হকের মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সঙ্গে নিয়েই নওগাঁ পৌরসভা-চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। আটকের পর ২৪ মার্চ সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিন মারা যান। তার মৃত্যুর পর রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুগ্ম সচিব এনামুল হকের করা একটি মামলার কথা জানা যায়, যেটি রেকর্ডের সময় ২৩ মার্চ, বিকেল বেলা। জেসমিন ও তার কথিত সহযোগী আল আমিনকে এতে আসামি করা হয়। আল আমিনকে ২৬ মার্চ ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তিনি একজন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট।
এনামুল হকের অভিযোগ, জেসমিন ও আল আমিন নামের ওই ব্যক্তি তার (এনামুল) ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছিলেন বিভিন্নজনকে। এভাবে তারা প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন।