জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস আজ
দিনের পর দিন নানা কারণে সড়ক দুর্ঘটনা, আহত ও নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতাও আগের চেয়ে বেড়েছে।
রোববার (২২ সেপ্টম্বর) সপ্তমবারের সারাদেশের পলিত হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। সরকারিভাবে এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে ‘আইন মেনে সড়কে চলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।
প্রতিবছর বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন মনগড়া সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে বলে ২০২২ সালে অভিযোগ তুলেছিল দেশের যানবাহন নিয়ন্ত্রক সংস্থ্যা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। তাই বিআরটিএ নিজেই এখন সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করে প্রতিদিন। সেই তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৪ হাজার ১৬টি সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭২৭ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৭৮১ জন আহত হয়েছেন।
এমনই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, বিআরটিএ চেয়ারম্যানসহ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলো একটাই কথা বলছে। আর সেটি হচ্ছে— ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা’।
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বাণী দিয়েছেন। সচেতনতার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। তার অংশ হিসেবে সরকারিভাবে রোববার সকাল ৯টায় দোয়েল চত্বরে সরকারিভাবে একটি র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। র্যালি শেষে সকাল ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এছাড়া আরও উপস্থিত থাকবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম রওশন আরা মান্নানসহ সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সেক্টরের কর্মকর্তারা। এছাড়া মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)।
পঙ্গুত্বের ভার আসলে কেউই নিতে চায় না
প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর। কখনও একটি ভয়াবহতার খবর আরেকটি খবরকে ছাপিয়ে যায়। হাজার খবরের ভিড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করা একটি খবর পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। ২০২০ সালের শুরুদিকে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করেন লিমন মিয়া। তিনি তখন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ক্যান্টিন বয় হিসেবে কাজ করতেন। কর্মক্ষমতার সঙ্গে উপার্জনের একমাত্র চাকরিটি হারিয়ে চিকিৎসা করাতেই যেন দম ফুরিয়েছে তার।
দুর্ঘটনা-পরবর্তী মুহূর্তের স্মৃতিচারণ তিনি বলেন, পঙ্গুত্বের ভার আসলে কেউই নিতে চায় না। যে কর্মস্থলে চাকরি করতাম, দুর্ঘটনার পরপরই সেখান থেকে বেতন দেয়া বন্ধ করে দেয়। এদিকে চিকিৎসা করাতে হিমশিম খেতে হয়েছে পরিবারকে। সবমিলিয়ে এখন মনে হয়, পঙ্গুত্ব আমার জীবনে বিশাল অভিশাপ হয়ে এসেছে। সংসারের হাল ধরতে ইন্টারের (এইচএসসি) পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন নিজেই পরিবারের বোঝা হয়ে গেছি।
শুধু লিমন নন, প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা বিভিন্ন কারণে দেশে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন শত শত মানুষ। বেঁচে থাকলেও তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকলেও সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে রোড সেইফটি ইউনিট গঠিত হলেও মূলত তারা টিভি মিডিয়ায় কথা বলা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাদের কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই।
তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে নানা ইউনিট ও প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনার মহামারি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষায় কোনো বাজেট নেই। এই মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক নেই, গবেষণা নেই, কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। ফলে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, নিরাপদ সড়ক তৈরিতে সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। এটির ফলাফল একেবারেই শূন্য না। মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তবে সড়কে শৃঙ্খলার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বাড়ছেই। সরকার বিগত বছরগুলোতে সড়কের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে অন্তর্ভুক্তিমূলক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আইনও যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। এসব কারণে সড়কে দুর্ঘটনা কমছে না।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে হলে সবার সচেতনতা দরকার, এতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সচেতন না হলে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।
তিনি বলেন, আমাদের এনফোর্সমেন্ট দুর্বলতা আছে। কারণ বিআরটিএ’র পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট নেই। তাহলে কীভাবে আমরা এনফোর্সমেন্ট নিশ্চিত করব। শুধু রাজধানী ঢাকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্তত ১০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট দরকার। কিন্তু আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট আছে ৫-৬ জন। এমন প্রেক্ষাপটে সামজিক আন্দোলন গড়ে না তুললে, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ তথা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি। সড়ককে নিরাপদ করতে ডিভাইডার স্থাপন, বাঁক সরলীকরণ, সড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, মহাসড়কে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ ও গতি নিয়ন্ত্রক বসানোসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়ন, দক্ষ চালক তৈরি এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন করেছি। আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং টেকসই ও নিরাপদ মহাসড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের সরকারের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, এবারই প্রথম সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির পরিবারকে এককালীন অন্যূন ৫ লাখ টাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানিসহ আহত ব্যক্তিকে অন্যূন ৩ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপদ সড়কের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে পারব, ইনশাল্লাহ।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে বলেছেন, সড়ককে দুর্ঘটনামুক্ত করতে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সবার সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যে উন্নত ও দক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারের গৃহীত নানামুখী উদ্যোগ পরিবহন খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
তিনি বলেন, এই লক্ষ্যে দেশব্যাপী গড়ে তোলা হয়েছে বিস্তৃত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। সহজ, আরামদায়ক ও ঝুঁকিমুক্ত সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিতকল্পে সড়ক ডিভাইডার নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সরলীকরণ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ, ট্রাফিক সাইন ও সিগন্যাল স্থাপন, পুনঃস্থাপন, গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়াসহ নানামুখী উদ্যোগ ও কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে সড়কে মোটরযানের সংখ্যা ও সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়, অনেক পরিবার চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সড়কে দুর্ঘটনা রোধকল্পে সরকারের গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের পাশাপাশি মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-নিষেধ জানা ও সেগুলো মেনে চলার বিকল্প নেই।
যে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’
১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। সেই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কে আন্দোলনে নেমে পড়েন তিনি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন গড়ে তোলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’। এই সংগঠনের নিরাপদ সড়কের দাবি হৃদয় ছুঁয়েছে সারা দেশের মানুষের। মানুষ সাড়া দেয় নিসচার ডাকে।
শুরুতে প্রতিবছর ২২ অক্টোবরকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালন করতো নিসচা। পরে এই দিনটিকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালনের দাবি জানানো হয়। নিসচার দাবির ফলে ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন করা হয়। এরপর ওই বছর থেকে ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে সরকারি উদ্যোগে জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।