আর্কাইভ থেকে দেশজুড়ে

পলিথিনের মোড়ানো তাবুতে মানবেতর জীবন হযরত আলীর

ধরলার পাড়ে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো তাবুতে মানবেতর জীবন-যাপন করছে ৬৭ বছরের এক অসহায় বৃদ্ধ। 

মঙ্গলবার (৯ মার্চ) সকালে উপজেলা সদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দুরে শেখ হাসিনা ধরলার সেতুর উত্তর পার্শ্বে ধরলা নদীর প্রটেকশন বাঁধের উপরে নুরনবী মিয়ার জমিতে কোন রকমেই যাযাবরদের মতোই বৃদ্ধ হযরত আলী (৬৭) পলিথিনের মোড়ানো তাবুর ভিতরেই সকালের খাবার রান্না করতে দেখা যায়। 

আপনি কেন রান্না করছেন, আপনার বউ-বাচ্চা নেই এমন প্রশ্ন হযরত আলীকে করলে তিনি উত্তরে জানান, বউ-বাচ্চা সবেই ছিল। এখন পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই। মুই (আমি) বড় একা বাহে (বাবা) ! দেখতেছেন মুই (আমি) নিজেই রান্না করছং (করছি) বাহে (বাবা)। জমি-জমাও নেই। ধরলার পাড়ত মানুষের জমিতেই পরিয়া আছনুং (ছিলাম)। কায়ো (কেউ) মোর খোঁজ নেয় নাই (রাখেনি)। সরকার অনেক মানুষকে জমি দিয়া প্যাঁকা ঘর তুলে দিচ্ছে। কিন্তু মোর কপাঁলে জোঁটেনি প্যাঁকা ঘর বাহে! হযরত আলী এভাবেই অতি দুঃখের সহিত কান্না জড়িত কন্ঠে আ লিক ভাষায় কথা গুলো বলেন। হযরত আলী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের সোনাইকাজী গ্রামের মৃত ইউনুফ আলীর ছেলে। 

বয়স বেশি হওয়ায় এখন আগের মতোই কাজ-কাম করতে পারে না। কোন রকম জীবন বাঁচার তাগিতেই মানুষের বাড়ীতে ধার-দেনা করেই দু-মুঠো খাবার জোটে। এমন কি কোন কোন দিন না খেয়েই রাত্রি যাপন করতে হয়েছে। কখনো কখনো প্রতিবেশীরা খাবার দিতো। এভাবেই চলে তার জীবন-জীবিকা। এক সময় স্ত্রী-সন্তান থাকলেও এখন কেউ নেই তার পাশে। অনেক কষ্টে ১০ হাত একটা টিনের ঘর তুললেও অভাবের তারনায় সেই পুরানো ঘরটি বিক্রি করেছেন হযরত আলী। তিনি এখন যাযাবরদের মতোই তিন থেকে চার মাস ধরে সোনাইকাজী এলাকার ধরলার পাড়ে নুরনবী মিয়ার জমিতে এক টুকরা পলিথিন দিয়ে তাবুতে ৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি চৌকি কেনে তিনি। 

চারদিকে খুঁটি বেঁধে সেখানেই টানিয়েছেন প্লাস্টিক ও ছেড়া কাপড়। এখন চৌকিতেই পেতেছেন সংসার। অসুস্থ হযরত আলী এভাবেই লড়াই-সংগ্রাম করেই চলছে। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। এক মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়েছে। ছোট মেয়েটা থাকেন নানির বাড়ীতে। ২০১৭ সালে তার স্ত্রী অভিমান করে ছোট ছেলেসহ বড় ছেলের সংসারে থাকেন। দুই ছেলেই এখন নারায়ণগঞ্জে গামেন্টসে কাজ করেন। ছেলের সংসার থাকা স্ত্রী জয়নব বেগম ২০১৮ সালের ১০ই জুলাই স্বামী হযরত আলীর কাছে তালাকের নোটিশ পাঠান। সে থেকেই হযরত আলী স্ত্রী-সন্তান ছাড়াই নিঃসঙ্গ জীবন কাঁটান। চোখের সামনে সন্তান থাকার পরেও পারে না বাবা ডাক শুনতে। অনেক কষ্টে গত রোববার বৃদ্ধ ভাতার ১ হাজার ৫শ টাকা পেয়ে স্বস্তি পেলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় চরম বিপাকে আছেন হযরত আলী।
 
স্থানীয় জাহিদুল ইসলাম জানান, হযরত আলীর কোন জমি নাই। ৩০ বছর ধরে তিনি মানুষের জায়গায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। স্ত্রীর সঙ্গে ঝঁগড়াঝাঁটি হওয়ায় স্ত্রী তাকে তালাকের নোটিশ দেয়। এই বৃদ্ধ বয়সে এখন কেউ নেই তার পাশে। ঘর উঠানোর মত কোন সামর্থও নেই। তাই তিনি খোলা আকাশের নীচে তাবু টাংগিয়ে এভাবেই সববাস করছেন।

স্থানীয় হারুন মিয়া ও এরশাদুল হক জানান, অসহায় মানুষটির দুর্দশার কথা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানলেও তারা তাদের জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বৃদ্ধ বয়সে আগের মত কাজ-কাম করতে পারে না। স্ত্রী-সন্তান থেকেও নেই। নিরুপায় হয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন। দেখছেন না বৃদ্ধ বয়সে ধরলার পাড়ে যাযাবরদের মতো খোলা আকাশের নিচে পলিথিন মোড়ানো একটি চৌকিতে বসবাস করছেন। ওই ঝুঁপড়ির মধ্যেই নিজেই অনেক কষ্টে রান্না করে খাবার খান। অনেক কষ্টে দুই-তিন আগেই বৃদ্ধ ভাতার টাকা পান। শুনে আমরা খুশি হয়েছি। বেঁচেড়া কিছুটা স্বস্তি পেল। তবে সরকার যদি এই অসহায় মানুষটিকে একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে ওই মানুষটি শেষ বয়সে একটু শান্তি পেত।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.তৌহিদুর রহমান জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীনদের চুড়ান্ত তালিকা করে গৃহনির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। আমরা তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছি। যদি সুযোগ থাকে তাহলে তার আবেদনের ভিত্তিতে চলমান বরাদ্দের মাধ্যমে তাকে গৃহনির্মাণ করে দেয়া হবে। আর যদি সুযোগ না থাকে তাহলে সামনের বরাদ্দে হযরত আলীকে এই প্রকল্পে তালিকাভূক্ত করে জমিসহ একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। 

রাইদুল শুভ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন