লিগ্যাল এক্সপার্টদের সঙ্গে নিয়ে ইউনূসের বিচার পর্যবেক্ষণে আসুন: খুরশীদ
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ‘ধারাবাহিক বিচার বিভাগীয় হয়রানি এবং কারাদণ্ড’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ২৪২ ব্যক্তি। তারা ড. ইউনূসের বিচার পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসার কথা জানিয়েছেন।
এই চিঠির জবাবে ড. ইউনূসের মামলার কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, যারা বিদেশ থেকে ড. ইউনূসের বিচার পর্যবেক্ষণে আসতে চান তাদের স্বাগত জানাই। তবে আমি বলবো, সঙ্গে লিগ্যাল এক্সপার্টদের নিয়ে আসুন।
কারণ নোবেল বিজয়ীরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনেক জ্ঞানী হলেও তারা বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং আইন, শ্রম আইন সম্পর্কে জানেন না। তাই আমি নোবেল বিজয়ীদের আহ্বান জানাব, লিগ্যাল এক্সপার্টদের সঙ্গে নিয়ে আসবেন। তিনি বলেন, এখানে নোবেলজয়ীর বিচার হচ্ছে না, এখানে মানি লন্ডারিংয়ের বিচার হচ্ছে। চিঠিতে ড. ইউনূসের বিচার স্থগিতের আহ্বান বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থায় অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের কাছে খুরশীদ আলম খান এসব কথা বলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ‘ধারাবাহিক বিচার বিভাগীয় হয়রানি এবং কারাদণ্ড’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ২৪২ ব্যক্তি।
ড. ইউনূসের ‘প্রহসনমূলক’ বিচারের অবসানের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ চিঠি লিখেছেন তারা। চিঠিটি গেলো ২৮ জানুয়ারি ‘প্রটেক্ট ইউনূস ডট ওয়ার্ডপ্রেস ডট কম’ ওয়েবসাইটে এবং ২৯ জানুয়ারি মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ করা হয়েছে।
ওই খোলা চিঠিতে বলা হয়...
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
আমরা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ধারাবাহিক হয়রানি এবং সম্ভাব্য জেলে যাওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে লিখছি। আমরা মতামত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত আইরিন খানের সঙ্গে একমত, যিনি গত ১ জানুয়ারি আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান এবং ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রায়কে ‘বিচারের নামে প্রহসন’ বলে মন্তব্য করেন।
আমরা এই অতি গতিশীল আইনি প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশের আইন কীভাবে প্রয়োগ হয়, সে বিষয়ে ধারাবাহিকতার অভাবের বিষয়টিকে উদ্বেগজনক হিসেবে নিয়েছি। ফৌজদারি মামলার রায়ে অলাভজনক সংস্থা গ্রামীণ টেলিকমের ৮৩ বছর বয়সী নির্বাহী ক্ষমতাহীন ও অবৈতনিক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনূসসহ প্রতিষ্ঠানটির চার বোর্ড সদস্যের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, প্রাসঙ্গিক আইনে গ্রামীণ টেলিকমকে কেবল অল্প জরিমানা করা যেত।
আমরা আরও লক্ষ্য করেছি যে, বাংলাদেশে গেলো ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী নেতাদের দমন ও কারাবরণ এবং মিডিয়া ও মুক্ত কণ্ঠস্বরকে দমন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ও বিদেশের অনেক মানবাধিকার এবং অন্যান্য গণতন্ত্রপন্থি সংস্থাও নথিভুক্ত করেছে।
অধ্যাপক ইউনূসের চলমান হয়রানি ও হুমকির বিষয়ে এর আগের ১০৮ নোবেল পুরস্কার বিজয়ীসহ ১৯০ জনের বেশি বিশ্বনেতার সই করা চিঠির জবাবে গত বছরের আগস্টের শেষদিকে একটি সংবাদ সম্মেলনে আপনি বলেছিলেন, ‘এক্সপার্ট পাঠাক, ল ইয়ার পাঠাক। যার বিরুদ্ধে মামলা তার দলিল দস্তাবেজ খতিয়ে দেখুক যে সেখানে কোনো অন্যায় আছে কি না। তারা এসে দেখুক।’ আমরা আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। শ্রম আইনের যে মামলার রায় ১ জানুয়ারি দেওয়া হয়েছে শুধু সেটিই নয়, সেইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান ইনভেস্টিগেশনও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
আমরা পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাধীন আইনি বিশেষজ্ঞদের একটি ছোট দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন সিনিয়র আন্তর্জাতিক আইনজীবীর প্রস্তাব করছি। আমরা শিগগিরই পর্যালোচনা শুরু করতে চাই এবং অনুরোধ করব যে, অধ্যাপক ইউনূস ও তার সহকর্মীদের যেকোনো কারাদণ্ডের সাজা এই পর্যালোচনা পর্যন্ত স্থগিত করা হোক।
আপনি জানেন, অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বের ২৪টি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬১টি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। বিশ্বের ৩৯টি দেশের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। তিনি ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননাসহ ৩৩টি দেশ থেকে ১৩৬টি সম্মাননা পেয়েছেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার, ইউনাইটেড স্টেটস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া ইতিহাসের মাত্র সাতজনের মধ্যে তিনি একজন। ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিকে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি তাকে 'অলিম্পিক লরেল' সম্মাননা দিয়েছে এবং ২০২৩ সালে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিটে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হয়। স্বাধীন গবেষণা অনুসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হয়তো তার উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা, যা বাংলাদেশে এবং অন্যান্য অনেক দেশে মানুষের জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি এনে দিয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূসকে বিশ্ব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে। প্রকৃতপক্ষে, দারিদ্র্য হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, বর্জ্য নিঃসরণ, সামাজিক ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা এবং সামাজিক ও পরিবেশগত অগ্রগতিতে অবদান, ক্রীড়াক্ষেত্রে গতিশীলতার জন্য তার মতো সক্রিয় নেতৃত্বের অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি সক্রিয়ভাবে আমাদের অনেক দেশে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। দুর্বল অভিযোগে তাকে কারাবাস করতে হলে, বিশ্বের জন্য তা হবে একটি বড় ক্ষতি।
এসব কারণে তার নিজের সরকার তার সঙ্গে কেমন আচরণ করছে, তা সব জায়গায় নেতা ও নাগরিকরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং তার সহকর্মীদের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়। শিগগির ন্যায়বিচারের এই প্রহসনের অবসান ঘটিয়ে আমরা আপনাকে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা সমুন্নত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।
চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর রয়েছেন। আরও আছেন তাওয়াক্কুল কারমান, নাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা ও হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসসহ ১৬ জন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রয়েছেন ৬ জন। তাদের মধ্যে ওরহান পামুক ও জে এম কোয়েটজি রয়েছেন। জোসেফ স্টিগলিৎজসহ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী আছেন ১২ জন। এ ছাড়া রসায়নে ৩৬ জন নোবেল বিজয়ী, চিকিৎসাশাস্ত্রে ২৯ জন নোবেল বিজয়ী এবং পদার্থবিজ্ঞানে ২৬ জন নোবেল বিজয়ী রয়েছেন।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, যুক্তরাজ্যের ধনকুবের স্যার রিচার্ড ব্রানসনসহ শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের তালিকায়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সামরিক কমান্ডারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন।