আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ

বাড়ি বদলের নেপথ্যে এক ভয়ঙ্কর গল্প!

সালটা ১৯৬৫। ডকিন পরিবারকে ঘিরে দানা বাঁধছে নানা রহস্য। কখনও এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে পারেনি এ পরিবার। ছোটবেলা থেকে এ ভাবেই দিন কাটছিল পলিনের। কে এই পলিন?

ডকিন পরিবারের বড় মেয়ে পলিন। তার পৈতৃক বাড়ি কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। পলিনের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখনই ওয়ারেন এবং রুথের (পলিনের বাবা-মা) বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

ওয়ারেন ছিলেন কানাডার একজন সফল ব্যবসায়ী । কিন্তু অত্যধিক মদ্যপান করতেন। রুথ দিনের পর দিন এ মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে পারছিলেন না। স্বামীর এ বদভ্যাস ছাড়ানোর জন্য রুথ স্থানীয় একটি কাউন্সেলিং দলে যুক্ত হন। সেখানেই আলাপ হয় স্ট্যানের সঙ্গে। স্ট্যান ছিলেন ওই দলের কাউন্সিলর ।

স্ট্যানের সাহায্যের পরেও কোনও লাভ হল না। ওয়ারেনের প্রবল নেশা করার কারণে বিবাহিত জীবনের ইতি টানেন রুথ। এর ঠিক দু’বছর পর রুথ তার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে উইনিপেগে বেড়াতে যান, ভ্যাঙ্কুভার থেকে যার দূরত্ব ১,৬০০ কিলোমিটার। সেখানে পৌঁছে রুথ জানান, তারা আর কখনও বাড়ি ফিরে যাবেন না।

এরপর মাঝেমাঝেই বাড়ি বদলাতে শুরু করেন রুথ। চার বছরের মধ্যে মোট ছয় বার স্কুলও বদলাতে হয়েছে পলিনকে। মনে নানা প্রশ্ন জাগলেও রুথ প্রতিবার একই উত্তর দিতেন— ‘‘এখন নয়। তুমি আরও বড় হলে সব কথা জানাব।
অবশেষে নিউ ব্রুনসউইক এলাকায় তারা স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করেন। 

পরবর্তীতে পড়াশোনার জন্য পলিন আলাদা থাকতে শুরু করেন। ২৩ বছর বয়সে স্নাতক শেষ করে পলিন সেন্ট জন সিটির স্থানীয় এক সংবাদপত্রে চাকরি পান। ঠিক তখনই রুথ তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান। অতীতের সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে পলিনও রাজি হন দেখা করতে।

শহরের কাছাকাছি এক মোটেলে দেখা করেন রুথ এবং পলিন। তবে মা ও মেয়ের প্রথম দেখাতেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ঘরে ঢোকার আগে একজন ওয়েটার পলিনের হাতে ধরিয়ে দেন একটি নোট এবং ফাঁকা খাম । নোটে লেখা, ‘‘পরনের সমস্ত গয়না খুলে এ খামের ভিতর ভরে দাও। তার পর ঘরে দেখা করতে এসো।’’ মায়ের এ রকম হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন পলিন।

তবুও রুথের নির্দেশ মতো গয়না খামের ভিতর ভরেই ঘরে এলেন তিনি। কিন্তু ঘরের ভিতর তার জন্য অন্য চমক অপেক্ষা করছিল। রুথের সামনে বসে রয়েছেন স্ট্যান। সব যেন গুলিয়ে উঠছিল পলিনের। শৈশবকাল থেকে যে অন্ধকারের মধ্যে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, তার উত্তর কি তবে রয়েছে স্ট্যানের কাছেই?

রুথ বলতে শুরু করেন, ছোটবেলা থেকেই বাইরের কিছু লোক তাদের উপর নজর রাখত। প্রাণহানিরও আশঙ্কা ছিল। তাই বার বার নিজেদের ঠিকানা বদলাতেন রুথ। এর জন্যে দায়ী তার প্রাক্তন স্বামী ওয়ারেন। তিনি মাফিয়া দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন স্ট্যানও। তার কাছে একজন মাফিয়া দলের লোক চিকিৎসা করানোর জন্য আসেন।

তিনি মাফিয়া জগৎ থেকে সরে গিয়ে একটি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চান। কথা প্রসঙ্গে মাফিয়া-জগতের অনেক কথাই স্ট্যানকে বলে ফেলেন তিনি। পরে সেই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ঠিক সেই সময় রুথেরও যাতায়াত শুরু হয় স্ট্যানের কাছে। সব মিলিয়ে মাফিয়াদের নজর পড়ে রুথ ও স্ট্যানের পরিবারের উপর।

অনেক সময় এরকমও হয়েছে, রুথকে ফ্রিজের ভেতর থেকে সব খাবার ফেলে দিতে দেখেছেন পলিন। রুথ বলতেন, খাবারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি ফেলে দিচ্ছেন, কিন্তু আসল কারণ ছিল অন্য। খাবারের মধ্যে বিষ মেশানো থাকতে পারে কি না, সেই ভয়েই সব খাবার ফেলে দিতেন রুথ। এমনকি, পলিন এবং তার ভাই টেডি স্কুল থেকে ফেরার পর তাদের ভাল করে পা পরিষ্কার করে মোজার উপর প্লাস্টিক ব্যাগ পরে থাকতে বলতেন তিনি।

রুথ তার মেয়েকে আরও জানান, তার পরিবার যখন যে এলাকায় গিয়ে থেকেছে, স্ট্যান সর্বদা তাদের ছায়াসঙ্গী হয়েছিলেন। আর তাই মাফিয়াদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা । স্ট্যান এবং রুথ সেই সংগঠনের সাহায্য নিয়ে একটি নতুন বাড়িতে থাকবেন। পলিনকেও তাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেন রুথ।

এসব শোনার পর স্তম্ভিত হয়ে পরেন পলিন। মনে হয়, শুধু নিজেরই নয়, তিনি তার প্রেমিক ও বন্ধুবান্ধবের জীবনেও বিপদ ডেকে আনবেন। তাই পলিন নিজের চাকরি, পুরনো সম্পর্ক ছেড়ে রুথ ও স্ট্যানের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

পলিনের ভাইয়ের বিয়ের সময় ওয়ারেন এসেছিলেন। কিন্তু রুথ জানান, লোকটি আসলে ওয়ারেনের ‘বডি ডবল’। মাফিয়া জগতের সঙ্গে জড়িত সকলেরই একাধিক ‘বডি ডবল’ থাকে। তাই কাউকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। পলিনও কয়েক বছর পর বিয়ে করেন। স্ট্যান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেন পলিনের।

একটা সময় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, রুথ ও স্ট্যানকে সন্দেহ করতে থাকেন পলিন। তাদের আচরণ অস্বাভাবিক লাগতে শুরু করে পলিনের কাছে। তাই এক অদ্ভুত ফন্দি আঁটেন তিনি। পলিনের বাড়িতে কয়েক জন হামলা করে জিনিসপত্র ঘেটেছে বলে জানান রুথকে। স্ট্যান ও রুথ কিছুক্ষণ পরে পলিনকে জানান, বহু দিন ধরেই তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে, এমনকি পলিনের ছবিও তুলে রাখা হয়েছে। ‘মর্স কোড’ পড়ে নাকি সব তথ্য জানতে পেরেছেন স্ট্যান।

একটি মনগড়া কাহিনিকেও সত্যি বলে প্রমাণ করতে চাইছেন তারা? তবে কি এত দিন পলিন মিথ্যে নিয়ে বেঁচেছিলেন? নানা প্রশ্নের ভারে জর্জরিত পলিন শেষে স্ট্যানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে শুরু করেন। জানলেন এক অভাবনীয় তথ্য।
সমাজের সকলেই স্ট্যানকে সম্মান করেন। কিন্তু একটি অদ্ভুত রোগ রয়েছে তার। নিজের ইচ্ছে মতো অবাস্তব জগৎ তৈরি করে বেঁচে থাকেন তিনি। স্ট্যানের সঙ্গে থাকতে থাকতে এ মানসিক ভ্রম রুথের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল।
স্ট্যান যা বলতেন, রুথও সেটাকেই বাস্তব বলে মেনে নিতেন।

স্ট্যান অবশ্য বেশি দিন বেঁচে থাকেননি। ক্যান্সার ধরা পরায় রুথও শেষ জীবনে পলিনের কাছে এসে থাকেন। ওয়ারেনের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন পলিন, ভেবেছিলেন তাকে সব জানাবেন। কিন্তু সেসময় তিনি আবার মদ্যপান শুরু করেছিলেন, এম্ফিসেমা রোগেও ভুগছিলেন ওয়ারেন। তাই তাকে আর কিছু বলেননি পলিন।

২০১০ সালে মারা যান রুথ। শেষ মুহূর্তেও পলিনকে সাবধানে থাকতে বলতেন রুথ। ডকিন পরিবারের ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যায়,একই পরিবারের দু’জন সদস্যের মানসিক অবস্থা ঠিক না থাকার কারণে পুরো পরিবারের উপর কী ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়তে পারে।

অনন্যা চৈতী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন