স্ত্রী চালাচ্ছেন বাস, স্বামী সেই বাসের কন্ডাক্টর
স্ত্রী বাস চালাচ্ছেন, আর স্বামী করছেন কন্ডাক্টারি। না এটা কোন প্রেমের কথা বলছি না। কাজটা তাদের করতে হয় সংসার চালানোর জন্য। তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ভারতের গোটা কলকাতা শহরে। অভাবের সংসারের হাল ধরতে শক্ত হাতে ধরেছেন স্টিয়ারিং। কে বলেছে বাস শুধু পুরুষ চালায়? শত শত যাত্রীর ভরসার জায়গা প্রতিমা পোদ্দার। একদিন তার স্বামী, তার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘সাবাস। তুমি পারবে। খেয়াল রেখো, একটা পিঁপড়ের গায়েও যেন আঘাত না লাগে’। প্রতিমা পোদ্দারের মূল অনুপ্রেরণা, তার স্বামী শিবেশ্বর পোদ্দার।
বাস চালানো পেশাটা শুধু পুরুষের না, এটি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছেন এই স্বামী-স্ত্রী। হাওড়া-নিমতা রুটে বাস ছুটিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রতিমা দেবী। একটা সময় সংসারে চরম অভাব ছিল। সংসার সামলাতে গাড়ি চালানোটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। যদিও বাস চালানোর আগে তিনি অ্যাম্বুলেন্স, ট্যাক্সি এবং প্রাইভেট কারও চালিয়েছেন। গাড়ি চালানোর এই শিক্ষা পেয়েছেন স্বামীর কাছ থেকে। অনুপ্রেরণার কথা বলতে গেলেই, তার মুখে বারংবার শোনা যায় স্বামীর কথা, শাশুড়ির কথা, বড় ননদের কথা। তবে বাধা যে ছিল না একেবারেই নয়। প্রচুর কানাঘুষো, জল্পনা, সমালোচনা, টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছে। যদিও সে সব দিকে তিনি ফিরেও তাকাননি। বিগত ১৮ বছর ধরে এখনো শক্ত হাতে স্টিয়ারিংটা ধরে রেখেছেন নিখুঁত ব্যালেন্সের সাথে। তার কাজকে স্বীকৃতি জানিয়েছে রাজ্য সরকারও।
থাকেন উত্তর চব্বিশ পরগনার নিমতাতে। রোজ সকাল হলেই রেডি হয়ে বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়েন স্বামী স্ত্রী। লড়াইটা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯৪ সালে। তখন বিয়ে হয় শিবেশ্বর পোদ্দারের সঙ্গে। স্বামী তখন অটো চালান। পরবর্তীকালে ট্যাক্সি চালাতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে পরিবারের সদস্য সংখ্যাও বাড়ে। দুই মেয়ে সহ গোটা পরিবারের দারিদ্রতা কম ছিল না। একা শিবেশ্বর পোদ্দারের পক্ষে পুরো সংসারটা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। প্রতিমা পোদ্দার ঠিক করে নেন, গাড়ি চালাবেন। কাজ থেকে ফিরে এসে তার স্বামী তাকে ট্যাক্সি চালানো শেখাতে নিয়ে যেতেন। যখন মিনিবাস চালানোর লাইসেন্স পেলেন তখনই তাকে আটকে দেয়া হয়। প্রায় কুড়ি দিন বাস চালাতে দেয়া হয়নি। জোর করে বহুবার প্রতিমা দেবীর গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে। সাথে ছিল ছিল প্রচুর ভোগান্তি। একবার ভাড়া না দিয়ে এক যাত্রী নেমে যাচ্ছিলেন, তাকে ধরতে গেলে উল্টে প্রতিমা দেবীর হাতে ধরে টেনে নামাতে চেয়েছে মানুষ। প্রথম দিকে তো নিমতা বাসস্ট্যান্ডেরর বাস চালকরাই তার বিরুদ্ধে বেঁকে বসে। কিন্তু প্রতিমা দেবী হার মানেননি। দমে যাননি। শুধুমাত্র তিনি মহিলাচালক বলে, তার গাড়িতে অনেকেই উঠতে চাইতেন না। কিন্তু যখন প্রতিমা দেবী যাত্রীদের একদম ঠিকঠাক নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই মানুষগুলোই দুহাত ভোরে আশীর্বাদ করেছেন তাকে। বাস চালিয়ে তিনি দুই মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। মেয়েদের নিজের হাতে শিখিয়েছেন যাত্রীবাহী বাস চালানো।
বাস চালানোটাকে তিনি আর পাঁচটা সাধারণ পেশার মতোই ভাবেন। যেখানে নারী পুরুষের আবার কিসের ভেদাভেদ? শিবেশ্বর পোদ্দার মনে করেন, তার স্ত্রী বাস না চালালে ১৫ বছর ধরে এই গাড়িটা তিনি চালাতে পারতেন না। তিনি চান, তার স্ত্রী ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত গাড়ি নিয়ে দৌড়ে বেড়াক। গোটা দেশ দেখুক, নারীরা চাইলে কি না করতে পারে।