একটা পরোটা খেয়ে দিন পার করছেন নব্বই বছরের বৃদ্ধ
একটা পরোটা খেয়ে অর্ধেক দিন পার করেছেন এক বৃদ্ধ। এমন নির্মম পরিস্থিতিতে পড়েছেন নব্বই বছরের অসহায় দিন মজুর আয়নাল হক। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মাথা গোঁজার ঠাই নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন তিনি। আয়নাল হকের বাড়ি ফুলবাড়ী উপজেলার চর গোরক মন্ডল গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত এন্তাজ আলীর ছেলে। তিনি দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক। দুই ছেলের আলাদা সংসার। বাড়ির পাশেই এক মেয়ের জামাই দিন মজুর হলেও বৃদ্ধ বাবা-মার কিছুটা হলেও খোঁজ খবর নেন বলে জানা গেছে।
আগ্রাসী ধরলা তীব্র ভাঙনে বাড়ির ভিটা-মাটি গিলতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে খাস জমির ওপর ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে ফেলার কাজও শেষ। কিন্তু কোথায় হবে তার মাথা গোঁজার ঠিকানা? মৃত্যুর কাছাকাছি সময় এসে এমন কঠিন সময় পাড় করবেন জীবনেও ভাবেননি তিনি। টানা চারদিন ধরে টিনের চালায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে দিন কাটাচ্ছেন আয়নাল হক। বৃদ্ধ আয়নাল হক ও তাঁর স্ত্রী আম্বীয়া বেগমসহ দুই জনের সংসার। আগে দিন মজুরী করে সংসার চালালেও এখন বয়সের ভারে দিন মজুরী কাজ ছেড়ে দেন। বাড়িতেই সামান্য পুঁজির ছোট একটা দোকান করেই অতিকষ্টে খেয়ে না খেয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এরই মধ্যে ঘর-বাড়িসহ তিন থেকে চার বার ধরলার ভাঙনে তিনি সব কিছুই হারিয়ে চরম দুরদিন পার করেছেন। নিজস্ব জমি না থাকায় সরকারি খাস জমিতে থাকতেন। সেই খাস জমিও ধরলা নদীর পেটে যাচ্ছে। বর্তমানে মানুষের দয়ায় কোন রকমেই এক বেলা খেয়ে না খেয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করলেও মাথা গোঁজার ঠাই টুকু কোথায় জুটবে এ নিয়ে চরম দুচিন্তায় পড়েছেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির উঠানে নিজের হাতে রোপনকৃত কাঁঠাল গাছ স্পর্শ করে ফ্যাল ফ্যাল করে নির্বাক দৃষ্টিতে ধরলার দিকে তাকিয়ে আছেন নব্বই বছরের বৃদ্ধ আয়নাল হক।
আয়নাল হকের সাথে কথা হলে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, কি কবো বাহে, খাস জমিও গেলো, এখন কোথায় যামু জানি না। শেষ স্মৃতি আমার হাতে রোপনকৃত এই কাঁঠাল গাছটির বড় মায়া হচ্ছে। অনেক কাঁঠাল ধরেছে। এই কাঁঠাল গাছটি রক্ষা করতে পারলাম না বাহে। তোমরাতো স্বচোখে দেখলেন ধরলা নদী আমার বাড়ির কাছে এসে বাড়ির-ভিটা গিলতে শুরু করেছে। পানি কমলেও এখনও নদীতে তীব্র স্রোত। দুই দিন আগে বাড়ি-ঘরগুলো বেড়া চাটি খুলে দিয়েছে। এক দিকে স্রোত অন্য দিকে ভাঙন যেকোন মুহুর্তে আমার বাড়ি ভিটাটুকু বিলীন হয়ে যাবে। এখন কি করবো বুঝতেছি না বাহে। নিজের বাড়ি-ঘর ও জমি-জমা ধরলায় বিলীন হলেও অন্যের বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি যাতে নদী গর্ভে বিলীন না হয় সেজন্য তিনি অশ্রু কন্ঠে দ্রুত চর গোরক মন্ডল এলাকায় ধরলার ভাঙন ঠেকাতে একটি টেকসই বাঁধ নির্মানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ হাছেন আলী জানান, চর গোরক মন্ডল এলাকার আয়নাল হকের বাড়িসহ গত এক থেকে দেড় বছরে ধরলার তীব্র ভাঙনে ৫০ টি পরিবার ও হাফ কিলোমিটার সড়কসহ শত শত ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর এক থেকে দেড় বছরে ৬ হাজার জিওব্যাগ দিয়েছেন। কিন্তু ভাঙন ঠেকানো যায়নি।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে ধরলার ভাঙনে হুমকির মুখে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মুজিব কেল্লার ভবন, স্কুল, মাদ্রাসাসহ ওই এলাকার এক হাজার পরিবার। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোডর্কে জানালে তারা চার দিন আগে মাত্র ২৫০ টি জিওব্যাগ দিয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ ১ লাখ জিওব্যাগ হলে ভাঙ্গন রক্ষা সম্ভব। তাই তিনি নদী গর্ভে বিলীন হাফ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক সংস্কার ও পুরোপুরি ভাঙন রোধ করতে স্থায়ী তীর রক্ষা বাঁধের জোড় দাবী জানিয়েছেন। সেই সাথে ভাঙনের শিকার অসহায় দিন মজুর আয়নাল হককে সব ধরণের সহযোগীতা করা আশ্বাস দেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ ইসমত ত্বোহা জানান, চর-গোরক মন্ডল এলাকায় ধরলা নদীর তীব্র ভাঙন ঠেকাতে ইতোমধ্যেই ৬ থেকে ৭ হাজার জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। আসলে জিওব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধ করা সম্ভব না। ভাঙন রোধে স্থায়ী তীর রক্ষা বাঁধ দেওয়ার জন্য কয়েক দফায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারপরেও ভাঙন রোধ করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ অব্যাহত আছে।
বৃদ্ধকে সহায়তার বিষয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রেহেনমা তারান্নুম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
কে/এস