স্ট্রোক এর কারণ ও লক্ষণ, প্রতিরোধ জেনে নিন
স্ট্রোক শব্দটি আমাদের খুব পরিচিত, তাই না? প্রায়ই আমরা পরিচিত মানুষের মাঝে কেউ স্ট্রোক করেছে শুনতে পাই। এই রোগটি সম্পর্কে কতটা জানেন? স্ট্রোক কী, কেন হয়, প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা থাকলে আপনি কিংবা আপনার পরিবারের প্রিয় মানুষটিকে খুব সহজেই বাঁচাতে পারবেন। আসুন জেনে নেই এই রোগের আদ্যোপান্ত।
স্ট্রোক আসলে কী?
এটি একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাঁধা পেলে বা ব্যাহত হলে, যখন রক্ত জমাট বেধে ধমনীকে ব্লক করে দেয়, তখন অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলো ডেড হয়ে যায় এবং মস্তিষ্কের কার্যকরী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এটিই হচ্ছে স্ট্রোক।
স্ট্রোক এর কারণ
স্ট্রোক কোথায় হচ্ছে, মস্তিষ্কের কতটুকু আক্রান্ত হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে পরবর্তী ব্যবস্থাপনা। এই ঘটনাটি যেকোনো বয়সের যেকোনো মানুষের সাথে হতে পারে। নারীদের তুলনায় পুরুষরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাইল্ড স্ট্রোক অর্থাৎ স্ট্রোকের পরিমাণ যদি কম হয়, তবে শুধুমাত্র হাত ও পায়ে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু স্ট্রোকের পরিমাণ বেশি হলে শরীরের একাংশ প্যারালাইসিস বা অবশ হয়ে যেতে পারে। এই সময় রোগী কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। এবার কখনও কখনও এই অবস্থায় রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
স্ট্রোক এর প্রকারভেদ
স্ট্রোক এর দু’টি প্রাথমিক প্রকার রয়েছে-
১. ইস্কেমিক স্ট্রোক: মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে রক্ত সঞ্চলনে ব্যাহত হওয়ার কারণে যে স্ট্রোক দেখা দেয় তা হলো ইস্কেমিক স্ট্রোক। সাধারণত এই ধরনের স্ট্রোক বেশি হতে দেখা যায়। এক গবেষণায় জানা গেছে প্রায় ৮৭% ক্ষেত্রেই ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়।
২. হেমোরেজিক স্ট্রোক: এই ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রক্তনালী ফেটে যেয়ে রক্তক্ষরণ হলে তাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলা হয়। এই ধরনের স্ট্রোক সাধারণত কম হলেও এটি কিন্তু বেশ গুরুতর। এটি যখন ঘটে তখন রক্তপাত মস্তিষ্কের টিস্যুকে সংকুচিত করে এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করে।
স্ট্রোক এর কারণ
১. উচ্চ রক্তচাপ: অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান ঝুঁকির কারণ। এটি রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে এবং এগুলোর ব্লকেজ বা ফেটে যাওয়ার জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
২. ধূমপান: ধূমপান রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করে এবং রক্ত জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
৩. ডায়াবেটিস: রক্তনালী ও স্নায়ুর সম্ভাব্য ক্ষতির কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে।
৪. উচ্চ কোলেস্টেরল: এলডিএল কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা ধমনীতে প্লাগ তৈরি করতে পারে এবং ব্লকেজ এর ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন: অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশনের মতো অনিয়মিত হার্টের ছন্দের কারণে হৃৎপিণ্ডে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা মস্তিষ্কে পৌঁছে স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
৬. স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় হওয়া ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
৭. পারিবারিক ইতিহাস: স্ট্রোক বা হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে কিছুটা হলেও ঝুঁকি থাকে।
৮. এছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপ, হতাশা, ডিপ্রেশনের কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।
স্ট্রোক এর লক্ষণ
স্ট্রোক এর লক্ষণগুলো শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগ নির্ণয়ে ‘FAST’ সাহায্য করতে পারে-
F: Face (মুখ)- মুখের একপাশে হঠাৎ দুর্বলতা বা ঝুঁকে পড়া
A: Arm (হাত)- উভয় হাত বাড়াতে বা উঁচু রাখতে অক্ষমতা
S: Speech (কথা বলা)- কথা জড়িয়ে যাওয়া অথবা সুসংগতভাবে কথা বলতে অসুবিধা
T: Time (সময়)- যদি কেউ এই লক্ষণগুলো অনুভব করে থাকে, অবিলম্বে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে
অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- গুরুতর মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, হাঁটার ভারসাম্য বা সমন্বয় নষ্ট হওয়া এবং হঠাৎ করে দৃষ্টি সমস্যা বা চোখে ঝাপসা দেখা।
রোগ নির্ণয়
স্ট্রোকের ক্ষতি কমানোর জন্য প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসা অপরিহার্য। চিকিৎসকরা স্ট্রোকের ধরন ও তীব্রতা নির্ধারণ করতে বিভিন্ন পরীক্ষা ও ইমেজিং কৌশল ব্যবহার করেন।
১. সিটি স্ক্যান: একটি কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (CT) স্ক্যান দ্রুত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং মস্তিষ্কের ক্ষতির পরিমাণ শনাক্ত করতে পারে।
২. এমআরআই: ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) মস্তিষ্কের বিশদ চিত্র প্রদান করে, ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
স্ট্রোকের চিকিৎসা নির্ভর করে এটি ইস্কেমিক স্ট্রোক (রক্ত জমাট বাঁধার কারণে) নাকি হেমোরেজিক স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তপাতের কারণে), সেটার উপরে।
ইস্কেমিক স্ট্রোক
১. উপসর্গ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোগী হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসক শিরায় থ্রম্বোলাইটিক্স (টিপিএ-এর মতো ক্লট-বাস্টিং ওষুধ) দিতে পারে।
২. কিছু ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে ক্লট অপসারণের জন্য থ্রম্বেক্টমি করতে পারেন।
৩. ভবিষ্যতে জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করার জন্য অ্যান্টিপ্লেটলেট বা অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ওষুধ নির্ধারিত করে দিতে পারেন।
৪. উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হাই কোলেস্টেরল থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ এর মেডিসিন
হেমোরেজিক স্ট্রোক
১. রক্তপাত বন্ধ করতে, জমাট বাঁধা অপসারণ বা ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালী রিপেয়ারের জন্য অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।
২. রক্তপাত রোধ, খিঁচুনি কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে হবে।
৩. নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে।
উভয় ধরনের স্ট্রোকের ট্রিটমেন্টের জন্য প্রয়োজন অনুসারে ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ যদি স্ট্রোকের লক্ষণগুলো অনুভব করেন, যেমন হঠাৎ অসাড়তা, বিভ্রান্তি, কথা বলতে সমস্যা, দৃষ্টি সমস্যা, তীব্র মাথা ব্যথা, বা হাঁটতে সমস্যা হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। মস্তিষ্কের ক্ষতি কমাতে স্ট্রোকের চিকিৎসা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফিজিওথেরাপি
স্ট্রোকের রোগীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হলে রোগী দ্রুত উন্নতির পথে আসতে পারে। স্ট্রোকের ধরন ও মাত্রা, বয়স, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি প্যারামিটারের উপর নির্ভর করে কোন রোগী কতদিনে ভালো হবে। কিছু রোগী ভালো কন্ডিশনে থাকেন। যেমন- কথা বলতে পারেন, নিজে খেতে পারেন। অনেকে কোনো একদিকের হাত-পা নাড়াতে পারেন না, এক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট দিয়ে ব্যায়াম করাতে হবে অথবা তাদের কাছ থেকে ব্যায়াম শিখে নিতে হবে।
স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায় কীভাবে?
বিশেষ করে যদি ঝুঁকির কারণ বা স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, সেক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা মেনে চলা উচিত। স্ট্রোক এর কারণ তো আমরা আগেই জেনে নিয়েছি। ঝুঁকি কমাতে নিচের পদক্ষেপ অনুসরণ করতে পারেন।
স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিন
ফল, সবজি, শস্যদানা, লো স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও সোডিয়াম সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন
নিয়মিত আপনার রক্তচাপ পরীক্ষা করুন এবং উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার জন্য আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে মেডিসিন গ্রহণ করুন।
ধূমপান ত্যাগ করুন
ধূমপান পরিত্যাগ স্ট্রোকের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ রক্তচাপ বাড়াতে পারে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও থাকে এক্ষেত্রে। তাই এই অভ্যাস বাদ দিতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন
প্রয়োজনে খাদ্য, ব্যায়াম ও ওষুধের মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
সঠিক ওজন ধরে রাখতে ও ফিট থাকতে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করুন।
প্রয়োজনীয় মেডিসিন গ্রহণ করুন
উচ্চ রক্তচাপ অথবা হাই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দেশিত মেডিসিন গ্রহণ করুন। অনেকে আছেন ঠিকমতো ওষুধ সেবন করেন না, গাফিলতি করেন! এই অভ্যাস পরিহার করুন।
অনেকেই স্ট্রোক আর হার্ট অ্যাটাককে সেইম মনে করেন। আসলে স্ট্রোক হলো ব্রেনের অসুখ আর হার্ট অ্যাটাক হৃৎপিণ্ডের সাথে রিলেটেড। স্ট্রোক এর কারণ আজ জেনে নিলেন। ধরন অনুযায়ী চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে রোগীর জীবন বাঁচাতে সহায়তা করুন। স্ট্রোক এর ঝুঁকির কারণগুলো প্রতিরোধ করে, হেলদি লাইফস্টাইল মেনটেইন করে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনতে পারেন। আসুন সবাই সচেতন হই, সুস্থ থাকি।
জেএইচ