মতামত

অভিবাসীদের আর্থিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সরকার যে উদ্যোগ নিতে পারে

বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে  প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন।  তবে অবসর নিয়ে দেশে ফেরার পর  অভিবাসীদের বেশিরভাগই অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় ভুগে থাকেন। এসব বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা জোরদারে একটি ‘অবসর সঞ্চয় প্রকল্প’ হতে পারে অন্যতম মাধ্যম।  অর্থমন্ত্রণালয়ের চারটি বিভাগের অন্যতম অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ব্যবস্থাপনায়  এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে পারে। এমনই প্রস্তাবনা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিবাসন বিশেষজ্ঞ  এবং  বেসরকারি সংগঠন ব্রিজ টু বাংলাদেশ এর ভাইস চেয়ারম্যান ও ‘দেশি প্রবাসী’র চেয়ারম্যান সাজেদুল চৌধুরী শন।

                                                          ছবি: সাজেদুল চৌধুরী শন

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আনার লক্ষ্যে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ব্র্যান্ড বাংলাদেশের প্রচার ও বাংলাদেশি বিনিয়োগ সুবিধা তুলে ধরতে রোড শো আয়োজনসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত ‘ব্রিজ টু বাংলাদেশ’। সংগঠনটির ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল চৌধুরী শন অভিবাসী কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা জোরদার করতে ‘বাংলাদেশি মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স রিটায়ারমেন্ট প্লান’ শীর্ষক একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন।

এই প্রস্তাবনায় অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্সের বিপরীতে দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তার একটি অংশ ওই প্রকল্পে জমা রাখতে হবে।  অভিবাসীরা ইচ্ছে করলে এর বাইরে অতিরিক্ত অর্থও ‘অবসর ফান্ডে’ জমা রাখতে পারবেন। করমুক্ত আয়ের প্রবাহ এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ এই প্রস্তাবনাটি অভিবাসী কর্মীদের জন্য ব্যাপক সুবিধা বয়ে আনতে পারে।  পাশাপাশি প্র্রকল্পটি রেমিট্যান্স পাঠানোর উপায় হিসেবে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রমকে রোধ করা ছাড়াও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে।  

রেমিট্যান্স ও অভিবাসীকর্মীদের বর্তমান অবস্থা:

     ১. অভিবাসীদের পাঠানো মোট রেমিট্যান্স: গত অর্থবছরে প্রবাসী বংলাদেশি শ্রমিকরা ২১ বিলিয়ন বা দুই হাজার একশো কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।  এই রেমিট্যান্স দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। রেমিট্যান্সের এই উল্লেখযোগ্য প্রবাহের একটি ভগ্নাংশের পরিমাণ অর্থ কাঠামোগত সঞ্চয় তহবিলে জমা দেওয়ার মাধ্যমে অভিবাসী কর্মীদের অবসর পরিকল্পনার সম্ভাবনাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। 

     ২. প্রত্যাবর্তনকারী শ্রমিক: কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে এ পর্যন্ত  প্রায় পাঁচ লাখ শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। এসব কর্মীদের অনেককেই সীমিত অবসরকালীন সঞ্চয়সহ আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একটি কাঠামোগত পরিকল্পনা এসব অবসরে আসা কর্মীদের এবং বর্তমানে যারা বিদেশে কর্মরত তাদের ভবিষ্যত আর্থিক স্থিতিশীলতা তৈরির জন্য একটি নিরাপদ উপায় সরবরাহ করবে।

পাঁচ বছরে সম্ভাব্য তহবিল বৃদ্ধি

আংশিক সরকারি অনুদান এবং অভিবাসী শ্রমিকদের অবদানে এই অবসর তহবিল সময়ের সাথে সাথে যথেষ্ট সঞ্চয় করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রতিবছর আসা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের এক শতাংশও যদি অবসর সঞ্চয় তহবিলে জমা রাখা যায় তবে তার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২১০ মিলিয়ন বা ২১ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ হবে প্রায় দুই হাজার ৫১২ কোটি টাকাটাকা(এক ডলার=১১৯.৬৪ টাকা ধরা হয়েছে)।

এভাবে প্রতিবছর জমা হতে থাকলে পাঁচ বছরে তহবিলের সম্ভাব্য আকার হতে পারে এরূপ: প্রথম বছর ২১০ থেকে ২২০ মিলিয়ন ডলার। পরের বছর যোগ হতে পারে ২২০-২৪২ মিলিয়ন ডলার। তৃতীয় বছর আরও ২৩০-২৬৫ মিলিয়ন ডলার, চতুর্থ বছর আরও ২৪০-২৯০ মিলিয়ন এবং ৫ম বছরে ২৫০-৩১৬ মিলিয়ন ডলার যোগ হতে পারে।  এভাবে পাঁচ বছর পর অবসর সঞ্চয় প্রকল্পে জমা হতে পারে এক দশমিক এক বিলিয়ন থেকে এক দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ পাঁচ বছরে অবসর সঞ্চয় তহবিলে জমা হতে পারে ১১০ থেকে ১৩৩ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা থেকে ১৫ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা।(এক ডলার=১১৯.৬৪ টাকা ধরা হয়েছে)। তবে এটি সরকারের অনুদান, রেমিট্যান্স ও  বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে।

অবসরে যাওয়ার পর তহবিলে অংশগ্রহণকারী অভিবাসী কর্মীদের এই সঞ্চয় তহবিল থেকে উল্লেখযোগ্য আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। পাশাপাশি তাদের নিরাপদ বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।  

নমনীয় অবদান এবং সরকারি অনুদান

অভিবাসী কর্মীদের জন্য এই প্রকল্পটি হয়ে উঠতে পারে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।  এখানে একজন অভিবাসী কর্মী সবোর্চ্চ সঞ্চয়ের জন্য অর্থ জমা রাখার সুয়োগ পেতে পারেন। এভাবে এই পরিকল্পনাটি  আয়ের সীমা অনুযায়ি অভিবাসী কর্মীদের  কাছে বেশি করে পৌঁছতে পারবে।

প্রস্তাবিত সুযোগ-সুবিধা এবং করমুক্ত আয়

         জীবন বীমা: কর্মী ও তাদের পরিবারের জন্য সাশ্রয়ী বীমা।

         বিমানবন্দর পরিষেবা: দেশে ফেরার সময় কর্মীদের সহায়তার জন্য বিশেষ সেবা।

         প্রত্যাবর্তন সহায়তা: মৃত কর্মীদের দেশে ফেরার জন্য আর্থিক সহায়তা।

        বাড়ি কেনার জন্য মিলিত ঋণ: বাংলাদেশে বাড়ি কেনার জন্য মিলিত ঋণের সহায়তা।

এছাড়াও,এই অবসর পরিকল্পনাটি পুরোপুরি কর-মুক্ত হবে,যা কর্মীদের তাদের আয় সর্বাধিক করতে সহায়তা করবে এবং দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

তহবিলের বিপরীতে ইক্যুইটি ঋণ

কর্মীরা তাদের সংগৃহীত তহবিলের সর্বোচ্চ ৭০% পর্যন্ত ইকুইটি ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন, যা জরুরি পরিস্থিতিতে বা বিনিয়োগের জন্য নমনীয়তা প্রদান করবে এবং অবসর সঞ্চয়ের বড় অংশটি সংরক্ষণ করবে।

অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল এবং মানি লন্ডারিং ঝুঁকি হ্রাসঃ

নিরাপদ, সরকার-সমর্থিত সঞ্চয় ও কর-মুক্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে, এই পরিকল্পনাটি হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক প্রেরণ চ্যানেলের উপর নির্ভরতা হ্রাস করতে পারে। প্রবাসী কর্মীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহারে আরও উদ্বুদ্ধ হতে পারেন, যা বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা এবং স্থিতিশীলতা প্রদান করবে। অনানুষ্ঠানিক প্রবাহের সাথে সম্পর্কিত মানি লন্ডারিং ঝুঁকি হ্রাসে জাতীয় নিরাপত্তাও সমর্থিত হবে।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা প্রচারঃ

ERD এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সরকারি বন্ড ও স্থায়ী আমানতের মতো কম ঝুঁকিপূর্ণ উপকরণে বিনিয়োগের মাধ্যমে, এই অবসর তহবিলটি অবসর সঞ্চয়ের জন্য স্থিতিশীল বৃদ্ধির পথ প্রদান করবে। এই উদ্যোগটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রচার করবে, বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য একটি নিরাপদ অবসর পথ তৈরি করবে, এবং আনুষ্ঠানিক রেমিট্যান্স প্রবাহকে শক্তিশালী করবে।

পরিশেষে বলা যায়, অভিবাসী কর্মীদের অবসর তহবিলের জন্য এই প্রস্তাবটি কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির একটি সমন্বিত এবং ভবিষ্যৎমুখী পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও উপকারী হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং ERD এর সমন্বিত তত্ত্বাবধান এই পরিকল্পনার সাফল্য নিশ্চিত করবে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশি কর্মী ও তাদের পরিবারের জন্য বৃহত্তর নিরাপত্তা প্রদান করবে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং চেয়ারম্যান, `দেশী প্রবাসী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন