ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক যেভাবে উন্নতি হতে পারে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রায় একই সময় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সোমবার (২০ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হতে পারে। আর ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠবে তা নিয়ে নানা আলোচনা এবং জল্পনা রয়েছে।
১. ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রধানত আমেরিকাকে কেন্দ্র করেই(America First”)। শপথ নেওয়ার পরই অভিষেক ভাষণে ‘উই উইল মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগানে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে মহান করে তোলার অঙ্গিকার করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন ইসলামপন্থি চরমপন্থার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলেও তারা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে প্রধানত বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখে থাকে।
কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতের জন্য বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু এবং দেশটি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র (Commercial Hub) হিসেবে বিবেচিত।
২. অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব
নানা কারণে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে। সম্ভাব্য সম্পর্কের বিভিন্ন দিকগুলো হলো-
(ক) গণতন্ত্র ও মানবাধিকার:
ট্রাম্প প্রশাসন সাধারণত মানবাধিকার ইস্যুতে আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে সেটা কৌশলগত স্বার্থের ক্ষেত্রে অনেক সময় পেছনে থাকে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে ইতিবাচক সমর্থন পাওয়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে।
(খ) চরমপন্থা বিরোধী সহযোগিতা:
ট্রাম্প প্রশাসন সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার চরমপন্থি দলগুলোর প্রভাব মোকাবিলা করতে সক্রিয় হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সহযোগিতা ও সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
(গ) চীনের সাথে সম্পর্ক:
ট্রাম্প প্রশাসন এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় সতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনের নজরে থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে এবং চীনের প্রভাবকে সীমিত করতে চায়, তাহলে ওয়াশিংটনের সমর্থন পাওয়া সহজ হবে।
৩. সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জসমূহ
(ক) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সতর্ক থাকবে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হয়, তবে এটি ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে পারে।
(খ) অভ্যন্তরীণ বিরোধ:
বাংলাদেশে যদি ইসলামী দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তবে এটি আন্তর্জাতিক মহলে, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিতে, নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
(গ) ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা:
ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুবই শক্তিশালী। ভারত যদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করে, তবে এটি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য সম্পর্ক সহজতর করতে পারে। তবে উল্টো পরিস্থিতি হলে সংকট তৈরি হতে পারে।
৪. ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
(ক) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ:
ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এই খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে।
(খ) সামরিক সহযোগিতা:
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সামরিক সহযোগিতা দিতে আগ্রহী হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়গুলোতে যদি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে, তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হবে।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক অনেকাংশে নির্ভর করবে কৌশলগত স্বার্থ, গণতন্ত্র ও চরমপন্থা বিরোধী কার্যক্রমের উপর। যদি উভয় পক্ষ পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে, তাহলে এই সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রমাণিত সক্ষমতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সক্রিয় সমর্থন।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং চেয়ারম্যান, দেশী প্রবাসী