৩৪ বছরের ব্যবধান পেরিয়ে অবিনাশী প্রেম

ভালোবাসা কি বয়স দেখে আসে? কিংবা সীমান্তের বাধা মানে? একসময় কেউই ভাবতে পারেনি যে এক বৃদ্ধা ইংল্যান্ডের মেঘলা শহর ছেড়ে মরুভূমির দেশে নতুন করে জীবন শুরু করবেন, কিন্তু ভালোবাসা তো এমন- এটি যখন আসে, তখন কোনো নিয়ম মেনে আসে না।
ক্রিস্টিন হেইকক্স, ৭৪ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ নারী, যিনি জীবনভর প্রেমের সংজ্ঞা খুঁজেছেন, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছেন তখন, যখন সমাজের চোখে তিনি প্রেমের বয়স পার করে এসেছেন। আর সেই ভালোবাসা এসেছিল দূর, বহু দূর থেকে- তিউনিসিয়ার এক যুবক হামজা দ্রিদির হাত ধরে।
তাদের গল্প একেবারেই স্বপ্নের মতো। বয়সের ব্যবধান, সংস্কৃতির ভিন্নতা, সামাজিক নিয়মের বাঁধন- কিছুই তাদের আটকাতে পারেনি। ভালোবাসার সেই পথচলা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে, যখন ক্রিস্টিন ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ইংরেজি শেখানোর জন্য আগ্রহীদের খুঁজছিলেন।
হামজা দ্রিদি তখন ৩৪ বছরের যুবক। তার স্বপ্ন ছিল ইংরেজি শেখা, যাতে তিনি বিশ্বকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তাই তিনি ক্রিস্টিনের কাছে ইংরেজি শেখার জন্য যোগাযোগ করলেন।
প্রথম দিন থেকেই তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকেই জমে উঠত কথোপকথন। হামজা জানতে চাইত ক্রিস্টিনের জীবনের গল্প, আর ক্রিস্টিন মুগ্ধ হয়ে শুনতেন হামজার তারুণ্যে ভরা স্বপ্নের কথা। একসময় দুজনেই বুঝতে পারলেন, এই সম্পর্কটা শুধুই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তাদের মনের এক গোপন কোণায় ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে।
তিন মাসের মধ্যেই ক্রিস্টিন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তিউনিসিয়া যাবেন হামজার সঙ্গে দেখা করতে। বন্ধুরা বলল, ‘এত তাড়াহুড়ো করো না, সে যদি প্রতারক হয়?’ কিন্তু ক্রিস্টিনের মন বলল অন্য কথা।
সুতরাং, ২০১৮ সালের এক উজ্জ্বল সকালে তিনি বিমানে চেপে বসলেন, হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছালেন তিউনিসিয়ার শহর হাম্মামেতে। বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা হামজাকে দেখে তার মনে হলো- এটাই তার গন্তব্য, এটাই তার মানুষ।
এরপর কেটে গেলো দু'সপ্তাহ, সমুদ্রসৈকতে হাঁটা, দিগন্তজোড়া সূর্যাস্ত দেখা, হাতে হাত রেখে পথচলা। এই দু'সপ্তাহেই ক্রিস্টিনের মনে হয়ে গেলো, এতদিন যে জীবন তিনি কাটিয়েছেন, সেটি শুধুই প্রস্তুতি ছিল এই ভালোবাসার জন্য।
দুই সপ্তাহ পর ক্রিস্টিন ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার পা আর পিছন ফিরে যেতে চাইলো না। তিনি থেকে গেলেন, হামজার সঙ্গে, সেই অপরিচিত কিন্তু আপন শহরে।
এরপর ২০২০ সালে তারা বিয়ে করলেন হামজার পারিবারিক বাড়িতে। ততদিনে ক্রিস্টিন বুঝে গিয়েছেন, এই ভালোবাসা কোনো লোভ বা স্বার্থের উপর দাঁড়িয়ে নেই, এটি একেবারে নিখাদ, নির্মল ভালোবাসা।
কিন্তু সমাজ কি এত সহজে ভালোবাসাকে মেনে নেয়? তারা যখন নিজেদের গল্প শেয়ার করলেন, তখন নানান সমালোচনা আসতে লাগলো। কেউ বলল, ‘হামজা শুধু টাকা আর ভিসার জন্য তার সঙ্গে আছে।’ কেউ কেউ তো এমনও বলল, ‘তোমার বয়সী একজন নারী কীভাবে এত কম বয়সী পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক চালাতে পারে?’
কিন্তু তারা থেমে থাকেননি। হামজা ক্রিস্টিনকে ভালোবেসেছেন তার ব্যক্তিত্বের জন্য, তার হৃদয়ের জন্য। ক্রিস্টিনও হামজার উষ্ণ ভালোবাসায় নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন নতুনভাবে।
এখন তারা চার বছর ধরে বিবাহিত। তারা একসঙ্গে একটি কুকুর পোষেন, যাকে তারা নিজেদের সন্তানের মতো দেখেন।
ক্রিস্টিন স্বীকার করেন, ‘আমরা দুঃখ পাই একটাই ব্যাপারে, যদি একটু আগে একে অপরকে পেতাম, তাহলে হয়তো আমাদের নিজেদের সন্তান থাকতো। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা তাতে একটুও কম নয়।’
তাদের পরবর্তী স্বপ্ন হলো হামজাকে যুক্তরাজ্যের ভিসা করানো, যাতে সে ক্রিস্টিনের বাকি পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে তারা যুক্তরাজ্যে ফিরে যেতে চান, কারণ ক্রিস্টিনের কিছু চিকিৎসার প্রয়োজন, যা তিউনিসিয়ায় সহজলভ্য নয়।
সূত্র: ডেইলি মেইল
এসি//