স্বশিক্ষিত হলেও শিক্ষার্থীদের ‘শেক্সপিয়র’ পড়াতেন রবীন্দ্রনাথ

অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নিজের নামেই সঙ্গীতধারা,নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। আবার কেউ কেউ বলেন, বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। ‘গুরুদেব’, ‘কবিগুরু’ ও ‘বিশ্বকবি’ অভিধায়ও ভূষিত করা হয়েছে তাকে। এতসব বিশেষণ, অভিধা কিংবা উপাধি কয়জনের ভাগ্যে জোটে? মাত্র একজন বাঙালির ভাগ্যেই জুটেছিল আর তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজ ৭ মে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। কলকাতা তথা ভারতের সুপরিচিত ও বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৬১ সালের এদিন (২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে)জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন। ওইসময় শিক্ষা-দীক্ষায়, শিল্পকর্ম, সঙ্গীত ও সাহিত্যের জন্য ঠাকুরবাড়ি বিখ্যাত ছিল।বিরল প্রতিভা দিয়েই হয়তো ঈশ্বর এদিন রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।
শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুর, বেঙ্গল একাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে দু-এক মাস করে পড়াশোনা করলেও পদ্ধতিগত শিক্ষা তাকে কোনোদিন অকর্ষণ করতে পারেনি। তাইতো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোকালে পড়ার সুযোগ হয়নি। ১৭ বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।পরের বছর ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।
তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন ছিল না। গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একারণে কাবগুরু ছিলেন স্বশিক্ষিত। তবে লন্ডনে থাকার সময় উইলিয়াম শেক্সপিয়র, পি বি শেলি, বায়রণ, জন কিটসসহ ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ পরিচয় ঘটেছিল।
ইংরেজ সাহিত্যিকদের এসব রচনা থেকে পাওয়া সাহিত্য সৃষ্টির উপকরণ এবং জীবনের বিদ্যালয় থেকে তিনি যে জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তা বাংলা সাহিত্যের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তাঁর স্পর্শ নেই। তাঁর রচিত গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, চিত্রশিল্প আমাদের বাংলা সাহিত্যের মর্যাদাকে অরও সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর চিঠিও সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।
কবিগুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের শান্তি নিকেতনে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’, ‘জুলিয়াস সিজার’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’, ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’সহ নাটকগুলো পড়াতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তার রচিত ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গানদুটি যথাক্রমে ভারত প্রজাতন্ত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। অনেকেই মনে করেন শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত-‘শ্রীলঙ্কা মাতা’ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয়ে লেখা হয়েছে।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের ‘নাইট’ উপাধি লাভ করেন। তবে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশি সাহিত্য সমালোচক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, সম্পাদক, অনুবাদক, কলামিস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলঅম চৌধুরীর মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কার কবিরা প্রত্যেকেই নিজেদের উঁচুস্তরের মনে করতেন। তারা কিন্তু শুধু লিখেছেনই, তার বাইরে যা করেছেন তাও ওই সাহিত্যের পাঠ ও পঠনের সঙ্গেই যুক্ত। তথাকথিত সাহিত্যিক ও অসাহিত্যিক কাজের ভেতরের ব্যবধান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন না। দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রোমান্টিক ও আবেগপ্রবন। আবেগের সঙ্গে তিনি লিখেছেন, সে জন্য যা-লিখেছেন তাই হয়েছে প্রাণবন্ত; সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের রচনাতে ছিল গভীর দার্শনিকতা।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কবিগুরু নিজেই বলে গেছেন, ‘আমি পৃথিবীর কবি যেথা যার যত ওঠে ধ্বনি/আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি’। তাই যথার্থ কারণেই তাকে বিশ্বকবি বলা হয়েছে। তাইতো অনেকেই মনে করে থাকেন "পূর্বে যদি না উঠিত রবি/আমিই হতাম বিশ্বকবি।" এই কথাটি প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের এবং তিনি আক্ষেপ করেই একথাটি বলেছিলেন।
এমআর//