লাইফস্টাইল

সম্পর্কে আঘাত, চলে যায় অন্ধকার জীবনে

মানুষের জীবন সম্পর্কের জালে বাঁধা। বন্ধন, ভালোবাসা, আস্থা এই সবই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যখন সেই সম্পর্কের ভিত্তি ভেঙে যায় তখন যে আঘাত পৌঁছায় তা কেবল শরীরে নয় মনেও গভীর খোঁচা দেয়। সম্পর্কের কোনও এক মুহূর্তে যখন আমরা প্রতারণার শিকার হই, সেই আঘাত দীর্ঘকাল আমাদের সঙ্গে থেকে যায়। কখনও কখনও সেই আঘাত এত গভীর হয় যে, মানুষ আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

সম্পর্কের গভীরে যখন বিশ্বাস ছিল, তখন জীবন ছিল একধরনের নিরাপত্তার অনুভূতি একটি অভ্যস্ত সুরক্ষা। কিন্তু, যখন সেই বিশ্বাস ভেঙে যায়, তখন কি অনুভূত হয়? এক কথায়, পৃথিবী যেন উলটে যায়। সম্পর্কের মধ্যে প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা বা একের পর এক মিথ্যে কথার শিকার হলে মানসিক বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য। এই মুহূর্তগুলোতে যখন আর কেউ পাশে থাকে না, তখন জীবন সত্যিই শেষ হয়ে যেতে পারে বলে মনে হয়। এমনকি কিছু মানুষ এ সময় এমন এক মানসিক অবস্থায় চলে যায়, যেখানে তারা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, আত্মহত্যা এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা। ২০১৯ সালে WHO-র এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। সম্পর্কের মধ্যে প্রতারণা কিংবা দীর্ঘসময় ধরে মানসিক অত্যাচারের শিকার হওয়া এই প্রবণতার অন্যতম কারণ। এটি একটি সতর্কবার্তা, যে সম্পর্কের মানসিক প্রভাব আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

সম্পর্কের মধ্যে প্রতারণা বিশেষভাবে মানুষের মানসিক অবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বিশ্বাস ভেঙে গেলে, ব্যক্তি সাধারণত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং শূন্যতার অনুভূতিতে ভুগে। মনোবিজ্ঞানী ড. মাইকেল রেসার বলেন, "একটি সম্পর্কের মধ্যে প্রতারণার শিকার হলে, বিশেষত দীর্ঘদিনের সম্পর্ক হলে, ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের ওপর এক বড় আঘাত আসে। মনের গভীরে শূন্যতার অনুভূতি তৈরি হয়, যা সুস্থ হতে সময় নেয়।"

এমনকি এই শূন্যতা, হতাশা এবং একাকীত্বের কারণে আত্মহত্যার চিন্তা চলে আসে। বিশেষত যখন একপাশ থেকে মানসিক অত্যাচার, তিক্ত সম্পর্ক, বা অবহেলা হতে থাকে, তখন এই অবস্থা আরও বাড়ে। একে 'মনস্তাত্ত্বিক শোষণ' বলা হয়, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

অতিমাত্রায় হতাশা বা মানসিক অবক্ষয়ের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে, তবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। মনোবিদরা বলেন, সম্পর্কের আঘাতের পর, বিশেষত যখন মানুষ একা এবং নিরাশ হয়ে পড়ে, তাদের প্রয়োজন সমর্থন, সহানুভূতি এবং সঠিক মানসিক সেবা। যদি আপনার চারপাশে কেউ মানসিক চাপের মধ্যে থাকে, তাকে সাহায্য করা, তার সঙ্গে কথা বলা, এবং তার অনুভূতিকে বুঝে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলি বারবার বলেছে, আত্মহত্যা কখনোই সমাধান নয়। আপনি যদি মানসিক অবস্থা খুব খারাপ মনে করেন, তাহলে সাহায্য নিন। পৃথিবীতে রয়েছে অনেকেই যারা আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। আপনি একা নন।

প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ আসতেই পারে কিন্তু যখন সেই চ্যালেঞ্জ নেতিবাচক হয়ে ওঠে, তখন সেটি শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজের জন্যও বিপদজনক হতে পারে। আত্মহত্যা বা মানসিক অবক্ষয়ের প্রবণতা রোধে আমাদের সকলের দায়িত্ব রয়েছে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা সমাজের অন্যান্য সদস্যদের উচিত এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহায্য করা।

স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চালানো দরকার। দেশের বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং সেবা কেন্দ্রগুলি মানুষকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু মানুষের মধ্যে সাহায্য চাইতে অস্বীকৃতি বা লজ্জার অনুভূতি কাটানোর জন্য আরও কাজ করা প্রয়োজন।

সূত্র :

১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), "আত্মহত্যা প্রতিরোধ"

২. আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ), "বিশ্বাসঘাতকতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব"

৩. জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ লাইফলাইন

৪. মানসিক স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন, "সম্পর্ক কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে"

এসকে// 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন