‘হাদিকে হামলার বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন ফয়সালের বান্ধবী’
রাজধানীর পল্টনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির আগের রাতেই হত্যাচেষ্টার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শ্যুটার ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান। ঢাকার সাভারে একটি রিসোর্টে অবস্থানকালে তিনি তার বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমাকে বলেছিলেন, পরদিন এমন একটি ঘটনা ঘটবে যা ‘সারা দেশ কাঁপাবে’।
ঠিক এর পরদিনই শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর পল্টন এলাকার বক্স কালবার্ট রোডে জুলাই যোদ্ধা হাদির ওপর গুলি চালানো হয়। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে পাওয়া এসব তথ্য নতুন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে, ওসমান হাদির ওপর হামলার বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন বান্ধবী মারিয়া। ঘটনার আগের রাতে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) রাতে ফয়সাল ও আলমগীর সাভারের গ্রিন জোন রিসোর্টের ২০৪ নম্বর রুমে রাত্রিযাপন করেন। সেখানে ছিলেন ফয়সালের বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা। ওই রাতে ফয়সাল তার বান্ধবীকে বলেন, ‘কাল (শুক্রবার) এমন কিছু হবে, সারা দেশ কাঁপবে’।
পরদিন শুক্রবার সকাল ৮টা ২৭ মিনিটে তারা রিসোর্ট ছেড়ে একসঙ্গে ঢাকায় আসেন। মারিয়াকে তিন হাজার টাকাও দেন ফয়সাল।
রিসোর্টের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সিয়াম নামে রিসোর্টের এক কর্মচারীর মাধ্যমে তারা চার হাজার টাকায় রুম বুকিং দেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে আর জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের এক সাবেক কাউন্সিলর ছিলেন এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড। অন্তত ২০ জনের একটি সংগঠিত গ্রুপ হত্যাচেষ্টা, অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ, পালিয়ে যাওয়া এবং সীমান্ত পারাপারে সহায়তায় জড়িত ছিল।
র্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, ম্যাগাজিন এবং কয়েক কোটি টাকার চেক।
রিমান্ডে গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ ধারণা করছে, এ ধরনের একাধিক শুটার গ্রুপ মাঠে সক্রিয় থাকতে পারে। এজন্য গোয়েন্দা সংস্থার চৌকশ সদস্যরা সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের অবস্থান চিহ্নিত করতে একযোগে মাঠে কাজ করছেন।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য বলছে, শুক্রবার দুপুরে হামলা চালানোর সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটটি ভুয়া ছিল। ঘটনার পর ফয়সাল ও আলমগীর চলে যান রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে বোন জেসমিনের বাসায়। সেখানে ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবিরও উপস্থিত ছিলেন। তিনি মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট বদল করে আসলটি লাগিয়ে দেন। ফয়সালকে পালাতে গাড়িও ডেকে দেন তিনি। এছাড়া ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া তার ভাই ওয়াহিদ আহমেদ শিপুকে দিয়ে বিকাশে ফয়সালের কাছে মোট ৪০ হাজার টাকা পাঠান। তবে জিজ্ঞাসাবাদে স্ত্রী সামিয়া দাবি করেছেন, তিনি ওসমান হাদির ওপর হামলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ফয়সাল নিয়মিত বাসায়ও থাকতেন না। তিনি ফয়সালের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে জানান।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানী ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পর্যন্ত যেতে যে প্রাইভেট কার ভাড়া করা হয়, এর চালক এখন পুলিশ হেফাজতে। তার দেওয়া তথ্যমতে আরেক প্রাইভেট কারচালকও নজরদারিতে রয়েছেন। যিনি ময়মনসিংহে যাওয়া প্রাইভেট কারটি ভাড়া করে দেন। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে গ্রেফতার করতে পারলে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। যদিও ধূর্ত ওই চালক ফোনসেট ও নম্বর পরিবর্তন করে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তদন্তে আরও জানা গেছে, ওসমান হাদিকে হত্যার লক্ষ্যে কয়েক কোটি টাকা ইনভেস্ট করার প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। শুটার ফয়সালের বাসা থেকে বেশকিছু চেকও উদ্ধার করা হয়েছে। ওইসব চেকে ফয়সালের স্বাক্ষর রয়েছে। এসব নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে ফয়সালের বোনের বাসার নিচ থেকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের ২টি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে র্যাব।
র্যাব জানিয়েছে, ম্যাগাজিন ও গুলি বোনের বাসা থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া হাদির ওপর গুলিবর্ষণে ব্যবহৃত অস্ত্রসহ দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, একটি খেলনা পিস্তল ও ৪১ রাউন্ড গুলি নরসিংদী সদর উপজেলার তরুয়া এলাকার মোল্লার বাড়ির সমানে তরুয়ার বিলে পানির মধ্য থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব। শ্যুটার ফয়সলের বাবা হুমায়ুন কবির ও মা মোসাম্মাৎ হাসি বেগমকে র্যাব-৩ গ্রেফতার করেছে। পরে তাদের মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন, ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের কথিত মালিক আবদুল হান্নান, সীমান্ত এলাকায় মানব পাচারে জড়িত সন্দেহে সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও এবং ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মোটরসাইকেলের মূল মালিক মো. কবির এবং ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী মোসাম্মাৎ হাসি বেগম।
এর মধ্যে আবদুল হান্নানকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রোববার তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সোমবার ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গ্রেপ্তার কবিরকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছে।
এ ঘটনায় ডিএমপির পল্টন থানায় ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবেরের করা হত্যাচেষ্টা মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। হাদি হত্যাচেষ্টায় কার কী ভূমিকা ছিল, এর পেছনে কারা কাজ করেছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার বেলা ২টা ২০ মিনিটে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট এলাকায় ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সিটি স্ক্যান এবং অস্ত্রোপচারের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিন রাতেই তাকে স্থানান্তর করা হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হয়েছে সিঙ্গাপুরে।
এসি//