ফুলবাড়ীতে মাদকের করাল গ্রাসে তরুন-যুব সমাজ
স্ত্রী-দুই ছেলেসহ চার সদস্যের সুখের সংসার। যেন সাজানো বাগান। বড় ছেলে(ছদ্দ নাম) জীবন অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
করোনা কালে কলেজ বন্ধ থাকায় বড় ছেলে পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়ীতে মুরগীর ফার্ম দিয়ে নিজের পায়ে দ্বারানোর চেষ্টা করছেন। একটু হলেও সংসারের সহযোগীতা করছেন। ছোট ছেলে(ছদ্দ নাম) আকাশ -দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে। সামনে এইচ এসসি পরীক্ষা দিবে।
স্ত্রী-দুই ছেলেসহ চার সদস্যের সংসার ভালই চলছিল। আমার ছোট আকাশ পড়াশুনার পাশাপাশি কখন কিভাবে যে বন্ধুদের সাথে সঙ্গ দিতে দিতে কখন যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তা আমার জানা ছিল না। যখন জানতে পারলাম আমার ছোট-ছেলে মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন,তখন থেকে আজও পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারিনি।
নেশার টাকার জন্য প্রায় বাড়ীতে ভাংচুর করতো সে। কখনো তার হাতে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি বলে হাউ-মাউ করে কেঁধে উঠেন অসহায় এক বাবা। তিনি পেশা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নাম না প্রকাশের শর্তে কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, ছোট-ছেলেটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে এক এক করে দুই রংপুরের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাই। এখনও রংপুরের শান্তি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে। ছেলেটা মাদকাসক্ত হওয়ায় সমাজে অনেক ছোট হয়ে বসবাস করছি।
যেন লজ্ঝায় কাউকে মুখ দেখাতে পারছিনা। শেষ বারের মতো মাদকাসক্ত সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য রংপুর শহরে শান্তি মাদক নিরাময় ক্লিনিকে ভর্তি করে দিয়েছি। জানি না কি হবে। এই সমস্যার শিকার শুধু তিনি একা নন। চারিদিকে সবুজের ঘেরা দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তঘেষা এলাকায় অনেক পরিবারের চিত্র এটি।
ফুলবাড়ী উপজেলার ৩৬ কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হওয়ায় লালমনিরহাট ১৫ বিজিবি’র সদস্যরা সর্তক অবস্থানে টহল অব্যাহত থাকলেও সুকৌশলে ভারতের উৎপাদিত মাদক দ্রব্য ইয়াবা ট্যাবলেট, ফেন্সিডিল, গাঁজা, মদ সীমান্ত পথে ভারত থেকে পাঁচার করে নিয়ে আসছেন চোরাকারবারীরা।
এই সব মাদক দ্রব্য স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীসহ যুব সমাজ বিপথগামী করে দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের ঠেঁলে দিচ্ছে। মাদকের কাঁচা টাকার সু-গন্ধে খুব সহজেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে অনেকেই জড়িয়ে যান সীমান্ত স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীসহ অনেক উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক জীবন-জীবিকার তাগিতেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুরো উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
ফুলবাড়ী থানা সুত্রে জানা গেছে, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা মাদক বিরোধী অভিযানে মাদক নির্মুল ও মাদক মুক্ত ফুলবাড়ী গড়তে রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখে গত ১ বছরে পুলিশ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও চোরাচালান প্রতিরোধ আইনে ফুলবাড়ী থানায় মোট ১৯১ টি মামলা দায়ের হয়েছে।
২০২০ সালে ১ লা জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফুলবাড়ী থানা পুলিশসহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে মোট ৩৩৮ কেজি ২২ গ্রাম গাঁজা, ৬ হাজার ৬০৯ পিচ ইয়াবা ট্যাবলেট, ১ হাজার ১৬১ বোতল ফেন্সিডিল, ১৮ বোতল মদ ও ২৬৬ বোতল স্কাপ সিরাপ উদ্ধার ও ২২৮ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশসহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা দিন রাত কট্টর শ্রম করে গত ১ বছরে ছয় মাসে ১৯১ টি মাদক মামলা ও বিপুল পরিমান মাদক দ্রব্য উদ্ধার এবং ২২৮ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করলেও কোন ক্রমেই থামছে না মাদক ব্যবসা।
উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের মাদকের নিরাপদ রুট গুলো হলো -সীমান্তঘেষা ১ নং নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চর-গোরকমন্ডল, আনন্দ বাজার, চর-আবাসন, গোরক মন্ডল, বিডিআর বাজার, নামাটারী, কৃষ্ণানন্দ বকসী, বালাতাড়ি, ধুলারকুটি, ক্যাম্পের ছড়া, জুগিটারী, গজেরকুটি, ঠোস খলিশাকোঠাল, খলিশাকোঠাল,বাদশার বাজার, চওড়াবাড়ী, কুরুষাফেরুষা, পূর্বফুলমতি, বালারহাট ও বারাইটারী, নাওডাঙ্গা বকুলতলা।
সীমান্তঘেষা ২ নং শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের ঠাকুরপাট, বোর্ডের হাট, টেপরীর বাজার, আছিয়ার বাজার, রসুন শিমুলবাড়ী, ভুরিয়ার কুটি,জুম্মাড়পাড়। সীমান্তঘেষা ৩ নং ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের ব্রাকমোড়, পানিমাছকুটি, চাঁন্দের বাজার, আব্দুল্লাবাজার, চৌত্তাবাড়ী মোড়, নাখারজান, ঠোস বিদ্যাবাগিস, দাসিয়ারছড়া, সীমান্তঘেষা ৬ নং কাশিপুর ইউনিয়নে গংগাহাট বাজার, আজোয়াটারী, কাশিয়াবাড়ী, বেড়াকুটি, অনন্তপুর, ধর্মপুর, বালাবাড়ীসহ উপজেলার বড়ভিটা,খরিবাড়ী,আমতলা,।
এই সব রুটে কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী, রংপুর, কাউনিয়া, রাজারহাট ও লালমনিরহাট থেকে শতশত তরুন-যুবকসহ বিভিন্ন বয়সী মাদক সেবনকারীর ঢল নামে। ফুলবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রাজীব কুমার রায় জানান, জেলা পুলিশ সুপার স্যারের নিদের্শে আমাদের থানা পুলিশসহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ফুলবাড়ী থানাকে মাদক মুক্ত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিনিয়ত মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে গত ১ বছরে মাদক ও চোরাচানের উপর ১৯১ টি মামলা ও বিপুল পরিমান মাদক দ্রব্য উদ্ধার এবং ২২৮ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিদিনেই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে চলবে। তিনি আরও জানান, স্থানীয় সচেতনমহল ও জনপ্রতিনিধিরা পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনীকে সহযোগিতা করলে চোরাচালানের বিরুদ্ধে ও মাদক সেবনকারী এবং মাদক ব্যবসায়ী একে বারে নির্মূল করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্নেল এস এম তৌহিদুল-আলম জানান, সীমান্তে রাত-দিন ২৪ ঘন্টা আমাদের বিজিবি’র সদস্যরা সর্তক অবস্থান থেকে ডিউটি পালন করছে। তবে কিছু অসাধু চোরাকারবারী তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিজিবিসহ বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, মসজিদের ইমামসহ সব ধরনের জনসাধারণ সহযোগীতা করলে সীমান্তে চোরাচানানসহ বিভিন্ন অপরাধ মূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
এস মুন্নী