মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিবন্ধন না দিতে সিইসিকে স্মারকলিপি
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টিসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিবন্ধন না দেয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে স্মারকলিপি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১।
আজ বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে এ সংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি দেয় সংগঠনটি।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা আপনাকে এই স্মারকলিপি দিতে এসেছি। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক কিছু সংকট আমাদের নজরে পড়েছে, আর তাই আমরা আজ নির্বাচন কমিশনে এসেছি। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে সম্প্রতি বিভিন্ন গণ মাধ্যমে লক্ষ্য করছি যে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় একশ নতুন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। তার মধ্যে বিশেষ করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে সদ্য প্রকাশিত রাজনৈতিক দল সম্পর্কে ইতোমধ্যেই একাধিক বিশ্বস্ত সংবাদ মাধ্যম বলছে, এই দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর যোগসূত্র আছে।
আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে যে মহাত্মারা ১৯৭১ সালে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ জীবনখানাই সমর্পণ করেছিলেন– আমরা তাদেরই সন্তান। আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি শহীদের রক্তে ভেজা এই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক বিশাল বধ্যভূমি। তাদের শোণিতধারায় এদেশের মাটি পবিত্র হয়েছে। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই পবিত্র মাটিতেই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় থেকে আমরা দেখেছি আমাদের আপন স্বজনের হন্তারকদের উত্থানের ভয়ানক অধ্যায়। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতরা দেশের মন্ত্রী হয়েছে, সংসদ সদস্য হয়েছে, রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বশীল পদ কলঙ্কিত করেছে।
প্রজন্ম ’৭১ এর কার্যক্রম বিস্তারিত তুলে ধরে উল্লেখ করা হয়, আমরা জানি যে, বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক গঠনতন্ত্রের কারণে ২০১৩ সালে জামাতে ইসলামী নিবন্ধন বাতিল করেন হাইকোর্ট। নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্ট একটি অংশ শুধু ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ নয়, জামায়াত থেকে বেরিয়ে আসা আরেকটি অংশ ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ নামে দল গঠন করে নিবন্ধনের আবেদন করে রেখেছে নির্বাচন কমিশনে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যেভাবেই হোক প্রকাশ্য রাজনীতিতে নামার দুরভিসন্ধি নিয়ে জামায়াত ভিন্ন নামে নিবন্ধন করার এই উদ্যোগ নিয়েছে- সে বিষয়টি ইতোমধ্যে দায়িত্বশীল একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে জেনেছি যে, উচ্চ আদালতের রায়ে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াত ইসলামের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বিডিপি– এমন অভিযোগের কথা বলা হলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছে যে, শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতেই পারে। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে আরও বলেছেন, জামায়াতের কেউ যদি যুদ্ধাপরাধী না হয় এবং তাদের গঠনতন্ত্র যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয় তাহলে শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে তাদের নিবন্ধন পেতে কোনো বাধা নেই। অথচ মাত্র দুমাস আগে ২৯ আগস্ট নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আলমগীর বলেছিলেন, যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামের নিবন্ধন আদালতের আদেশে বাতিল হয়েছে তাই দলের ব্যক্তিরা ভিন্ন নামে আবেদন করলেও নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আদালত কোনো আদেশ দিলে ভিন্ন কথা। নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীরের সাংবাদিকদের দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যের বৈপরীত্য আমাদের স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত ও শঙ্কিত করছে।
শাহরুখ লিপিকার উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জামায়াতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পরে জামায়াতের নেতা মাওলানা আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে এবং ছয়টি আসন জয়লাভ করে। পরে দেশের পরিস্থিতি আরও তাদের অনুকূলে গেলে একাত্তরের চিহ্নিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নেপথ্যে রেখে আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির করে নিজ নামে (জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) নির্বাচনে ফিরে আসে জামায়াত। তাই এবারেও আগত নির্বাচনে অংশ নিতে জামায়াতের নেতারা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসার পাঁয়তারা করছে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
এই পর্যায়ে আমরা আপনাকে বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জেনোসাইড সংঘটনে শুধু সহায়তাই করেনি, সজ্ঞানে জেনোসাইডের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্র শিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ঘৃণা, গুম, হত্যাসহ তাদের চরম সাম্প্রদায়িক নৃশংসতাভিত্তিক রাজনীতির চর্চা অব্যাহত রাখে।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১ মনে করে - আজ নির্বাচন কমিশনকে দেশ মাতৃকার প্রশ্নে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশনের এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের রাজনৈতিক দর্শন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হবে, নাকি শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমাজ গড়ে তোলার প্রশ্নটি গুরুত্ব পাবে, অব্যাহত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালনকারী যেকোনো ব্যক্তি ও তাদের সমর্থক ব্যক্তি বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার রহিত করা নির্বাচন কমিশনের অবশ্য কর্তব্য বলে আমরা শহীদদের উত্তরসূরিরা মনে করি। সর্বশেষে আমরা বলতে চাই, সাধুবেশী ধর্ম ব্যবসায়ীর দল একাত্তরে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে- স্বাধীন বাংলাদেশ সেই একই ভাবাদর্শে বিশ্বাসী নব্য স্বাধীনতাবিরোধীদের, এমন কি যারা অনেকেই একাত্তরের পরে জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের প্রেত-নৃত্য দেখেছে এবং দেখছে।
আমরা মনে করি, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দেশবিরোধী শক্তিকে বৈধতা দানের যে অপচেষ্টা চালাচ্ছে নানা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ– তার অবসান হওয়া জরুরি। তাই বিডিপিকে ঘিরে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার, জামায়াত নেতাদের নেয়া সিদ্ধান্তের ফসল বিডিপি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচারিত তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যথাযথ তদন্ত করার জন্য আমরা আপনাকে সবিনয় অনুরোধ করছি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই সব দেশবিরোধী শক্তি শাখায়-প্রশাখায় যেন আর বাড়তে না পারে সেবিষয়ে আপনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।