নতুন রূপকথার নায়ক অপ্রতিরোধ্য এমবাপ্পে
যখন তিনি দৌড় দেন, মনে হয় যেন ছুটে চলছেন কোনো পৌরাণিক পুরুষ। তাকে থামানো মানুষের অসাধ্য। মানুষটা আর কেউ নন, ২৪ বছর বয়সি এমবাপ্পে। তাকে দেখলে যে কারো মনে গ্রিক পুরাণের সেই গল্পটা উঁকি দেবে। যদিও হিপোমেনেসের মতো তিনি শেষ হাসি হাসতে পারেননি। আর্জেন্টিনার কাছে ফাইনালে পরাজিত হয়ে দেশে ফিরতে হলো শিরোপাবিহীন।
তবে ঠিক ভালোভাবেই চিনিয়ে দিয়েছেন পরিচয়। রোববার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ম্যাচের ৮০, ৮১ ও ১১৮ মিনিটে করা তিন গোল ফ্রান্সকে কেবল খেলাতেই ফিরিয়ে আনেনি, তৈরি করেছে অনন্য মাইলফলক।
বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিকের দৃশ্য মাত্র একবার দেখেছিল ফুটবল দুনিয়া। ১৯৬৬ সালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ইংল্যান্ডের স্ট্রাইকার স্যার জিওফ হার্স্ট করেছিলেন সেটি।
সত্যিকার অর্থেই গত দুই আসরে ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এমবাপ্পে। গোলপোস্টের দিকে তিনি যখন বল নিয়ে ছুটে যান, মনে হয় ক্ষুধার্ত চিতা শিকারের লক্ষ্যে ছুটে চলে নিবিষ্ট মনোযোগে। পাসগুলো যেন শিল্পীর অভ্যস্ত হাতে আঁকা অ্যারাবেস্ক। যেন বল লুফে নেন না তিনি। বল স্বেচ্ছায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো বসে পড়ে তার সামনে।
ট্রফিটা অল্পের জন্য হাতছাড়া হলেও টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৮ গোল করে মেসিকে পেছনে ফেলে গোল্ডেন বুট জিতে নিলেন এমবাপ্পে। দুই টুর্নামেন্ট মিলিয়ে গোলসংখ্যা দাঁড়াল ১২। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবেই ফিফার ২৪ বছরের কম বয়সী শ্রেষ্ঠ গোলদাতা এই ফরাসি তরুণ। ৭ গোল নিয়ে তার পেছনে রয়েছেন গত শতকের মহানায়ক পেলে। পেছনে রয়েছেন লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
এখানেই শেষ নয়। এ বয়সেই তিনি গোল সংখ্যায় ছাড়িয়ে গিয়েছেন ম্যারাডোনা ও ব্যালন ডি’অর বিজয়ী পাওলো রোসিকে। বিশ্বকাপে মাত্র ১৪টি ম্যাচ খেলে সর্বকালের সেরা গোলদাতার তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে। এখানে অবস্থানটা পেলের সঙ্গেই। যেখানে ২৪ ম্যাচে ১৬ গোল নিয়ে প্রথমে রয়েছেন মিরোস্লাভ ক্লোসা।
ফ্রান্সের হয়ে ঘরোয়া ফুটবলে পাঁচটি পদক তুলেছেন ঝুলিতে, করেছেন ২৫০ গোল। চার বছর আগেই স্পর্শ করেছেন বিশ্বকাপ। আরো একরাশ রেকর্ড যেন তাকে স্পর্শ করবে বলে প্রতীক্ষা করছে। ২০১৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই টিনএজ হিসেবে জোড়া গোল করেছিলেন এমবাপ্পে। ১৯৫৮ সালে টিনএজার হিসেবে শুধু পেলে করেছিলেন সেই রেকর্ড। ৬০ বছর পর এমবাপ্পে যেন ফুটবল দুনিয়ায় নতুন জাদুকরের আগমনবার্তা। জাদুকরই বটে। গতি, ছন্দ, ড্রিবলিং আর বলের ওপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা জাদুর চেয়ে কম কিসে!
২০১৯ সালে ফরাসি সংবাদমাধ্যম ‘লা পারিজিয়ান’-কে দেয়া সাক্ষাত্কারে পেলে আস্থা প্রকাশ করেছিলেন, নিজ প্রজন্মের রাজা হয়ে ওঠার সব গুণই রয়েছে এমবাপ্পের মধ্যে।
প্যারিসের অভিবাসী পরিবারে ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন এমবাপ্পে। ক্যামেরুন থেকে আসা বাবা উইলফ্রেড ও আলজেরিয়ান মা ফাইজা লামারি। ফুটবল কোচ হওয়ার কারণে উইলফ্রেড সন্তানকে ছোট থেকেই তৈরি করেন। তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি, বেশ ভালোভাবেই সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এমবাপ্পে। নিয়ে এসেছেন চমকের পর চমক। জিদান, রোনালদো নাজারিও ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে আদর্শ মেনে প্রস্তুত করেছেন নিজেকে।
২০১৫ সালে মোনাকো ক্লাবের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সিনিয়র দলে প্রবেশ। ২০১৭ সালে ১৮০ মিলিয়ন ডলারে চুক্তিবদ্ধ হন পিএসজির সঙ্গে। মোনাকো থেকে পিএসজিতে যাওয়ার ঘটনাটি এখন পর্যন্ত খেলোয়াড় হিসেবে দ্বিতীয় ব্যয়বহুল ট্রান্সফার। টিনএজ হিসেবে অবশ্য এটাই সর্বোচ্চ মূল্যে ক্লাব পরিবর্তন। এমবাপ্পেকে ফুটবল বিশ্বের ‘পরবর্তী পেলে’ বলে অভিহিত করেছেন আর্সেনালের সাবেক ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার। তিনি বলেছেন, সব যোগ্যতাই রয়েছে তার। অপেক্ষা শুধু সময়ের।
ফুটবল বিশ্বে এক দশক ধরেই চলছিল সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে, সেই তর্ক। শিরোপা জিতে বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন মেসি। বিশ্বকাপকে পূর্ণতা দেয়ার পাশাপাশি নিজেকে প্রমাণ করেছেন সময়ের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে। তবে সব গল্পেরই সমাপ্তি আছে।
২০০৬ সালে বিশ্বকাপে প্রবেশের পর থেকে গোল্ডেন বল ও বুটসহ প্রায় সব ধরনের পালকই যুক্ত হয়েছে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মুকুটে। পঁয়ত্রিশের মেসি ও সাঁইত্রিশের রোনালদোর জন্য কাতারই শেষতম আসর। তাদের পর ফুটবল বিশ্বে যে শূন্যতা দেখা দেবে, সে সময়ের জাদুরকাঠি এমবাপ্পের হাতেই থাকবে বলে অনায়াসে মেনে নেয়া যায়।
মাত্র দুটি আসর শেষ হলো। এখনো এমবাপ্পে নিজেকে ঝালাই করে চলছেন প্রতিনিয়ত। কোনো ইনজুরি ছাড়া যদি পাঁচটি আসরে অংশ নিতে পারেন; যদি এ গতি, ছন্দ ও দক্ষতা ধরে রাখতে পারেন, তাহলে এমবাপ্পের মহানায়ক হয়ে ওঠা অপ্রতিরোধ্য। ফুটবলের ইতিহাসে নতুন রূপকথা সময়ের ব্যবধান মাত্র।