আর্কাইভ থেকে তথ্য-প্রযুক্তি

চ্যাটজিপিটি দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে কেন!

ইন্টারনেট এবং মুঠোফোন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এ দুটো ছাড়া যেন আধুনিক জীবন কল্পনা করা অসম্ভব। খুব শীঘ্রই প্রযুক্তি জগতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসতে চলেছে, যেটি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বনে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি হলো, চ্যাটবট।

গুগল, মাইক্রোসট, মেটা - একে একে সবাই চ্যাটবট তৈরিতে ব্যস্ত। এগুলোকে মানুষের জন্য আরও সুবিধাজনক এবং ব্যবহারোপযোগী করার জন্য গবেষণায় মত্ত  টেক জায়ান্টগুলো। তবে অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক উদ্ভাবনের মতোই, এই চ্যাটবটগুলোরও সীমাবদ্ধতা আছে, এগুলোর ত্রুটির কারণে অনেক সমালোচনাও হয়ে থাকে।

সম্প্রতি চ্যাটজিপিটি নামে একটি চ্যাটবট চালু করেছে ওপেনএআই। আপাতত পাবলিক টেস্টিংয়ের জন্য এটির ব্যবহার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ওপেনআই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানি, যার একজন প্রতিষ্ঠাতা হলেন ধনকুবের ইলন মাস্ক।

ধরা হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যাটবট হলো চ্যাটজিপিটি। উন্মুক্ত করে দেয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। খবর ডেইলি মেইল অনলাইন-এর।

চ্যাটবট কী?

চ্যাটবট হলো এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গঠন করা হয়। এটি একটি বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল যাকে অসংখ্য ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। ফলে কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মানুষের মতো করে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে; অর্থাৎ ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে পারে।

চ্যাটজিপিটি কী?

ওপেনএআই বলছে, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক নামক একটি মেশিন লার্নিং কৌশল ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এটি কথোপোকথন শুরু, প্রশ্নের উত্তর প্রদান, ভুল স্বীকার, ভুল অনুমান চ্যালেঞ্জ এবং অযাচিত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম।

অন্যান্য চ্যাটবটের মতোই চ্যাটজিপিটিও দ্রুত সময়ে সাড়া দিতে সক্ষম। শুধু তা-ই নয়, আরও কিছু আকর্ষণীয় ফিচার রয়েছে এটির। রচনা লেখা থেকে শুরু করে গানের লিরিক্স লেখা, গল্প লেখা, এমনকি কবিতা লিখতেও নির্দেশ দেয়া যাবে এই চ্যাটবটকে। আর মার্কেটিং পিচ, স্ক্রিপ্ট, অভিযোগ পত্র লেখা তো আছেই!

চ্যাটজিপিটির প্রতিষ্ঠাতা

এই নতুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমটি তৈরি করেছে ওপেনএআই। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্যান ফ্রান্সিসকো শহরে এই কোম্পানিটি অবস্থিত।

২০১৫ সালে গঠিত ওপেনএআই-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইলন মাস্ক, স্যাম অ্যাল্টম্যান এবং আরও অনেকে, যাদের সম্মিলিত মূলধন ছিল এক বিলিয়ন ডলার ( ১০০ কোটি ডলার)। বর্তমানে এর সিইও হিসেবে ক্লর্মরত আছেন স্যাম অ্যাল্টম্যান। ২০১৮ সালে দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও এর দাতা হিসেবে রয়ে গেছেন ইলন মাস্ক।

এটি কীভাবে কাজ করে?

পাবলিক টেস্টিংয়ের জন্য অ্যাপটির যে ভার্শন উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে সেটির উদ্দেশ্য হলো, ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন বুঝতে পারা এবং সেসব প্রশ্নের যথাসম্ভব গভীরতর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা, ঠিক অনলাইন কথোপোকথনে মানুষের লিখিত টেক্সটের মতো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চ্যাটজিপিটি-এর মতো টুল বাস্তবিক প্রয়োগে ব্যবহার করা যাবে যেমন, ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন কন্টেন্ট তৈরি, কাস্টমার সার্ভিসের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ইত্যাদি। মানুষের কথা বলার ধরন অনুসরণ করে এই চ্যাটবটটি অসংখ্য প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে সক্ষম।

এটি প্রাথমিকভাবে জনসাধারণের কাছে বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। অল্পসময়ে চ্যাটজিপিটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ওপেনএআই-এর ডেমো লিংকটি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

উন্মুক্ত করে দেয়ার প্রথম পাঁচদিনের মাথায় এক মিলিয়নের বেশি মানুষ এতে সাইন আপ করে ফেলেন। যেখানে এমন ব্যবহারকারী পেতে ফেসবুক এবং স্পটিফাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর মাসের পর মাস লেগেছিল।

সম্ভাবনা

চ্যাটজিপিটি আমাদের বিভিন্ন ডিভাইস তথা মেশিনের সঙ্গে কথোপকথনের ধরনে আমূল পরিবর্তন আনবে - এমনটা দাবি করা হয়েছে ওপেনএআই-এর পক্ষ থেকে।

জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম সফটওয়্যারটি। ফলে অনেকের ধারণা, এটি গুগলের সার্চ ইঞ্জিন একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে।

গুগলের সমালোচকরা বলেন, এই সার্চ ইঞ্জিনটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। এবং ব্যবহারকারীদের অনুসন্ধানের (গুগল সার্চ) ফলাফলে কৃত্রিক বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেছে।

জিমেইল প্রতিষ্ঠার পেছনে ভূমিকা ছিল পল বুশেইট-এর। ৪৫ বয়সী এই ডেভেলাপার মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের আধিপত্য শীঘ্রই খর্ব হবে।

তিনি টুইট করে বলেন, 'মাত্র এক বা দুই বছরের মধ্যে গুগলের আধিপাত্য সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সার্চ ইঞ্জিনটির রেজাল্ট পেইজ অপসারিত করবে, যেটি থেকে গুগলের মুনাফার সিংহভাগ আসে।

কিন্তু চ্যাটজিপিটি এর ঠিক বিপরীত উত্তর জানায়।

'বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এআই চ্যাটবট কি গুগলের সার্চ ইঞ্জিন আধিপত্য নির্মূল করে দেবে?' - ডেইলি মেইল-এর পক্ষ থেকে চ্যাটজিপিটিকে এমন প্রশ্ন করা হয়।

অনেক বড়সড় উত্তর চলে আসায় আবার একটা ছোট উত্তর চাওয়া হয়। চ্যাটবটটির উত্তর আসে, 'এআই চ্যাটবট, এমনকি অত্যাধুনিক এআই চ্যাটবট গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের আধিপত্য শেষ করতে সক্ষম হবে - এমনটা অসম্ভব।'

উত্তরে আরও ছিল, 'এআই চ্যাটবট কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা। অন্যদিকে গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলো ডিজাইন করা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে তথ্য অনুসন্ধান (সার্চ) করার জন্য। অদূর ভবিষ্যতে এআই চ্যাটবট সার্চ ইঞ্জিনগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হবে - এটি অসম্ভব।'

চ্যাটজিপিটি-এর প্রতিদ্বন্দ্বী কারা?

গুগল ইতোমধ্যে তাদের নিজস্ব এআই প্রতিষ্ঠা করছে। এর অংশ হিসেবে জনপ্রিয় এ সার্চ ইঞ্জিনটি বর্তমানে কথোপকথন বিষয়ক এবং ভয়েস সার্চ নিয়ে গবেষণা করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতকে আরও অগ্রসর করতে গুগল ডিপমাইন্ড নামক একটি এআই কোম্পানি নিয়ে কাজ করছে।

পিছিয়ে নেই মেটা এবং মাইক্রোসফট

চলতি বছরের আগস্ট মাসে ফেসবুকের মাতৃ-প্রতিষ্ঠান মেটা একটি এআই গবেষণা রিসার্চ প্রজেক্ট চালু করে। এর নাম দেওয়া হয় ব্লেন্ডারবট থ্রি। এই চ্যাটবটটি মূলত ইন্টারনেটে প্রচলিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উত্তর দিয়ে থাকে।

মজার বিষয়, চ্যাটবটটিকে তার মালিক অর্থাৎ মার্ক জাকারবার্গকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে উত্তরে কিছু নেতিবাচক শব্দ আসবে।

কিছু সাংবাদিক ব্লেন্ডারবট থ্রি'কে জাকারবার্গ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বটটি জবাব দেয়, মার্ক জাকারবার্গ 'উদ্ভট এবং ধান্দাবাজ।' মার্ক 'সবসময় নৈতিক' নয় বলেও জবাব দেয় চ্যাটবটটি।

এমনকি মার্ক জাকারবার্গের পোশাক নিয়ে মন্তব্য করতে ভোলেনি এই বট! মার্ককে 'হাস্যকর' বলে উল্লেখ করে এটি বলেছে, তিনি 'এখনো একই পোশাক পরেন।'

চ্যাটজিবিটি-এর মতোই ব্লেন্ডারবট থ্রি'কেও পাবলিক ডেমো হিসেবেই ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালে মাইক্রোসফট তাদের এআই চ্যাটবট টে চালু করে। এটি মূলত ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, অনলাইনে তরুণদের কথোপকথনের ভাষা বোঝা।

কিন্তু চালু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টুইটার ব্যবহারকারীরা টে-এর অ্যালগরিদমের ত্রুটির সুযোগ নেন। একসময় চ্যাটবটটি বর্ণবাদী এবং আক্রমণাত্মক উত্তর দেওয়ায় সঅমালোচনার ঝড় ওঠে। এঁটে মাইক্রোসফটকে বাধ্য হয়ে ব্যবহারকারীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়।

চ্যাটজিপিটি কি ত্রুটিমুক্ত?

বর্ণ, জেন্ডার এবং সংস্কৃতি নিয়ে সামাজিক পক্ষপাতকে স্থায়িত্ব দেওয়ায় এআই প্রযুক্তি বেশ বিতর্কিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা তাদের কিছু প্রজেক্টের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে অ্যালফাবেট ইংক-এর গুগল এবং আমাজন-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেগুলো 'নৈতিকভাবে অনির্ভরযোগ্য।'

অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক উদ্ভাবনের মতোই স্বাভাবিকভাবেই চ্যাটজিপিটি ত্রুটিমুক্ত নয়।

টুলটির 'আপাতত বিশ্বাসযোগ্য প্রতীয়মান, কিন্তু ভুল বা অর্থহীন উত্তর' দিয়ে সাড়া দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে বলে স্বীকার করেছে ওপেনএআই। তবে এই সমস্যার সমাধান করা চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। চ্যাটবটটি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে পারে বলেও সতর্ক করেছে তারা।

চ্যাটজিপিটির বর্তমান

নানা উদ্বেগ এবং সমালোচনা সত্ত্বেও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত গবেষণা এখনও বেশ আকর্ষণীয় ক্ষেত্র।

অর্থায়ন নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি পিচবুক-এর হিসাব অনুযায়ী, গতবছর এআই-এর ক্ষেত্রটিতে মূলধন বিনিয়োগ প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে।

ওপেনএআই চায় মানুষ তাদের পরীক্ষামূলক চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করুক, যাতে করে কোম্পানিটি আরও ডেটা নিয়ে বটটিকে আরও অগ্রসর করতে পারে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন